এসেছে নতুন শিশু...

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সেই বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্রে’ লিখেছেন—এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ।
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
কতটুকু পেরেছি মোরা সরাতে জঞ্জাল, নাকি অহংকার বুকে রেখেছি পুরোনো স্মৃতিকে, বুকে জড়িয়েও সে কতইনা আদরে। সময় বদলিছে, কিন্তু সেটা মিছে, ভাবে বসে বর্ষীয়ান। তাই সে বলে, আমাদের সময় সে দিব্যি যথার্থ, কত কিনা করলাম, কত কিনা খাইলাম। মানুষে মানুষে কতইনা সৌহার্দ্য ছিল। বর্ষীয়ান করে ধুলো নতুন প্রজন্মগুলো, নাকি বহু বেয়াদব। কেমনে করে সে আশা, না সরায়ে জঞ্জাল; চায় নতুন প্রজন্মও তাতে দিবে গাছের ডাল। কিন্তু চেষ্টা সে করিবে, বুড়ো বুকের বলে, মান্য করিতে বাধ্য নতুন প্রজন্মকে ছলে। নতুন প্রজন্ম তাই বাধ্য হয়ে, জঞ্জালের ওপর জঞ্জাল ঢালে। তাহলে নতুন প্রজন্ম এগোবে কীভাবে?
বর্ষীয়ানদের উচিত কবি সুকান্তের সুরে সুর মেলানো, ‘প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল’। কিন্তু জঞ্জাল না সরিয়ে, কেন এরা কেবলই এতে গন্ধ বাড়ায়। উপরন্তু নতুন প্রজন্মকে সেই জঞ্জালের ওপর জঞ্জাল তৈরিতে উৎসাহ জোগায়।
জঞ্জালের ওপর জঞ্জাল দিলে এরা খুশি হয়, কিন্তু এরা নাহি জানে, অজান্তে দিচ্ছে কালি সভ্যতার মুখে। তাই বুঝি ইতিহাস কতইনা কলঙ্কে ভরা। দায়ী কি এরা? পুরোনো জঞ্জালে বর্ষীয়ান মূর্খ যদি না পারো সরাতে অনন্ত ঢালো কেরোসিন, নতুন প্রজন্মকে দাও মশালের দিন। তারা যেন পারে অন্তত ভস্ম করিতে তব জঞ্জাল। কিন্তু কেন তুমি বসে, কাটাও সময় অলসে, চাও আবার নতুন প্রজন্ম যেন শুয়ে তব ঘা ঘেঁষে। এই যদি ভাব, নাহি হবে নতুন প্রজন্ম, সভ্যতার নাহি হবে কোনো উন্নতি। তাতে কি? বাপ–দাদারা স্বয়ং দিল এ শিক্ষা, দেখ তাকিয়ে, দেখ আমাকে! কতই ভালো জীবন আমার। বাস্তবে কি তাই! মানি সে ভালো, তবে অধিকতর ভালো করতে নতুন প্রজন্মের ক্ষমতা আছে। সুযোগ তাই দিতে হবে। আসলে বর্ষীয়ান কেন নতুন প্রজন্মকে বাধ্য করে, জঞ্জালের ওপর জঞ্জাল ঢালার চেষ্টা করে? হিংসা এর উত্তর, সে যে কষ্টে ছিল। দেখিয়া নব্য প্রজন্ম, জ্বলে সে কয়লার আগুনে, ভেতরে-ভেতরে। তাই নাহি চায় নব্য প্রজন্ম হায়, থাকুক একটু সুখে, নাহি থাকিতে বল মোর এই বৃদ্ধ বুকে।
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ—পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। ইহারা সেটা মানতে নারাজ। ব্যস্ত করিতে অদ্ভুত চিন্তা, নতুন প্রজন্মকে ঈর্ষা, এরা ভুলে যায় একদিন ওদের যেতে হবে বহুদূর। মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে শোকে মরে এরা, কেন নতুন প্রজন্ম এমন হলো। সময়ের সাথে মানবজাতি বদলায়, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সেটা এরা মানতে নারাজ, তাই ব্যস্ততা কাটে নতুন প্রজন্মকে, ফিরিয়ে নিতে পুরোনো দিনে। ব্যর্থ এরা মরে ধুকে ধুকে, নতুন প্রজন্মের মনে দেয় এরা বিষের স্বাদ। নতুন প্রজন্ম তাই ভুলে আপন সংস্কৃতি আপন সংসার, মিশে যেতে চায় অন্য সংস্কৃতিকে, যেন কাঁক সাজে ময়ূর বেশে। কার দোষ ইহার? নতুন প্রজন্মের বা বর্ষীয়ানের? বর্ষীয়ান যদি করিত সর্ব জঞ্জাল পরিষ্কার এবং এ বিশ্বকে এ নতুন প্রজন্মের বাসযোগ্য করিত, তাহলে না হইতো কভু নতুন প্রজন্মের কাঁক হয়ে ময়ূর সাজার স্বাদ।
বর্ষীয়ানদের কি করিতে মানা? রুখিতে নতুন প্রজন্মের তেষ্টা, রুখিতে নতুন প্রজন্মের সৃষ্টিশীলতা, রুখিতে নতুন প্রজন্মের নব্য উদ্দাম। এসেছে নতুন প্রজন্ম, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান। ছেড়ে দাও তোমার স্থান, জীর্ণ শরীর নিয়ে দখল করে কেন বসিয়া থাকো? এ তোমার স্থান নয়। মাটির ভেতরে এক পা ধরে, আরেক পা বসে ওই স্থানের ওপরে। কি করিতে চাও তুমি প্রমাণ? শ্রেষ্ঠত্ব তোমার? জীর্ণ শরীরই বলে দেয় চিৎকার করে, কেমন তুমি অযোগ্য ওই স্থানের। জীর্ণ শরীরের দেয়াল সে তো নতুন প্রজন্ম চাহিলে লাথি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। কেউ তা নাহি করে। এ নতুন প্রজন্ম জানে করিতে বর্ষীয়ানদের সম্মান। তাই বলে ওদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে না। মানুষের রক্তে মাংসে গড়া নতুন প্রজন্মের শরীর, তাই মানুষেরই মত ভুল হবে একদিন। সেদিন অপেক্ষা না করে ছেড়ে দাও ওদের প্রাপ্য স্থান। কেঁকড়াবৃত্তি বন্ধ কর।