বইমেলা এবং একটি স্বপ্নের খসড়া


চলতি বছর ২৯তম নিউইয়র্ক বইমেলা হচ্ছে। ২৯টি বছর যিনি এই স্বপ্নকে লালন করছেন, তিনি মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা। আমার দেখা একজন আশ্চর্য মানুষ। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি এই কাজটি করছেন। নিউইয়র্ক বইমেলা একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ হয়েছে। একদিন আমরা থাকব না, কিন্তু স্বপ্ন থাকবে। দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষেরা এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বিশ্বজিৎ সাহা বিদেশে বাংলাভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি চর্চার যে দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত থাকবে। দুই বাংলার সাহিত্যিক, প্রকাশক ও পাঠকদের একটি অপূর্ব মিলনমেলার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন তিনি।
আমি প্রথম নিউইয়র্ক বইমেলায় যোগ দিই সম্ভবত ২০০৫ সালে। ২০০৩ সালে আমি কানাডা অভিবাসী হই। প্রথম এক বছর আমি অটোয়ায় বসবাস করি। ২০০৪ সালে আমি টরন্টোতে আসি। তখনো আমার কানাডার পাসপোর্ট হয়নি। কিন্তু আমার বাংলাদেশ পাসপোর্টে আমেরিকার ভিসা ছিল। কারণ এর আগেও আমি কয়েকবার আমেরিকায় এসেছি। তাই আমি ভাবলাম, নিউইয়র্ক বইমেলায় যাব। এর আগে আমি বিশ্বজিৎ সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। তবে নাম শুনেছি। তিনি নিউইয়র্কে বইমেলা করেন জেনেছি। কানাডায় এসে যোগযোগ হলো। তিনি আমাকে বইমেলায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন। সেবার নিউইয়র্কে গিয়ে আমার অন্য রকম অনুভূতি হয়েছিল। বাংলাদেশ, কলকাতা ও উত্তর আমেরিকার অনেক লেখকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সামনাসামনি দেখা। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছর বইমেলায় অংশ নিয়েছি।
আমার তেমন কোনো স্বপ্ন ছিল না। যখন যা মনে হয়েছে করেছি, যখন যেখানে যেতে ইচ্ছে করেছে গেছি, যখন যার সঙ্গে সখ্য করতে ইচ্ছে করেছে করেছি। পূর্বাপর কিছু ভেবে করিনি। এখনো আমার এই স্বভাবটা রয়ে গেছে। সামনে আগুন আছে না পানি, ওসব ভাবি না। আমি তেমন ক্যালকুলেটিভ না। অন্যদের মতো আমি অত চুলচেরা হিসাব–নিকাশ করে চলতে পারি না। আজকের দিনটির জন্য বাঁচতে চাই। একটা সুন্দর দিন পার করতে পারাটা বিরাট কিছু আমার কাছে। আমি অনেক কিছুই পাব না, অনেক কিছুই হতে পারব না, তাই ওসব নিয়ে চিন্তিত নই আমি। তবে আমি একটা স্বপ্ন মনের মধ্যে সব সময় লালন করতাম।
যেদিন আমি শংকরের ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ বইটি পড়ি, সেদিন আমি ঠিক করলাম একদিন আমেরিকা দেশটায় যাব। ওরকম একটা দেশ পৃথিবীতে সত্যি আছে! সেটি শৈশবের কথা। সত্যি সত্যি ১৯৯৮ সালে আমি প্রথম আমেরিকা নামক দেশটায় পা রাখলাম। সেটা ছিল নিউইয়র্ক শহর। সেটাই আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ এবং সেই থেকে নিউইয়র্ক আমার প্রিয় শহর হয়ে আছে। তারপর যখনই সুযোগ পেয়েছি, ছুটে গেছি নিউইয়র্ক। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে আমি প্রতি বছর নিউইয়র্ক আসি বইমেলা উপলক্ষে। মুক্তধারা আয়োজিত এই মেলায় সবার সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রিয় লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশকেরা আসেন, আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন লেখক বন্ধুরা।


মনে আছে, যখন বিচিত্রায় কাজ করতাম তখন প্রতিদিন নিউজপ্রিন্টের প্যাড আর বলপেন নিয়ে মেলায় চলে যেতাম। থাকতাম মহসিন হলে। বিকেল হলে একলাফে বাংলা একাডেমি। সেটা ছিল ১৯৮৪ সাল। আমাদের কয়েকজনের দায়িত্ব ছিল স্টলে স্টলে ঘুরে নতুন বইয়ের খবর নেওয়া। পাঠক, লেখক আর প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলা। এ ছাড়া মেলার টুকিটাকি নিয়ে লিখতাম। সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকা করতাম। পাঠক বিচিত্রার কাটিং নিয়ে আসত বই কিনতে।
সেই থেকেই বইমেলার সঙ্গে একটা নিবিড় সখ্য গড়ে উঠে। বরিশাল থেকে এসেছিলাম লেখকদের কাছ থেকে দেখার আশায়। আমিও টুকিটাকি লিখি, কিন্তু কখনো বই প্রকাশিত হবে জানতাম না। অনেক চড়াই–উতরাই আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমার জীবন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু বইমেলা থেকে কখনো দুরে থাকিনি। যেখানে যে অবস্থায় থেকেছি, ছুটে গেছি মেলায়। ২০০৩ সালে কানাডাপ্রবাসী হওয়ার পরও প্রায় প্রতিবছর দেশে গেছি। নিজের বই প্রকাশিত না হলেও গেছি। নিজের আর্থিক ক্ষতির কথা ভাবিনি। কতবার চাকরি খুইয়েছি। ছুটে গেছি নিউইয়র্ক বইমেলায়, কলকাতায়। ১১ বছর ধরে টরন্টো বইমেলার আয়োজন করছি আমরা।
যখন থেকে শুরু করেছিলাম, তারপর প্রায় ৩৮ বছর পেরিয়ে গেছে। ঢাকার বইমেলার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। অনেক নতুন নতুন লেখক আর প্রকাশক তৈরি হয়েছে। বেড়েছে পাঠক আর বইয়ের সংখ্যা। অনেক লেখককে হারিয়েছি আমরা। আমার নিজেরও প্রায় ৩০টির মতো বই প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে না থাকলে এই সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতে পারত। লেখালেখির জগতে আমার কেউ ছিল না, আমি একা পথ চলেছি সব সময়। কিন্তু আমার ছিল আবেগ।


আমি লিখি আমার আনন্দের জন্য। আমার ভেতরে অনেক আবেগ আছে, অনেক না–বলা কথা আছে সেসব আমি লিখি। শৈশব কৈশোর থেকেই আমি একলা মানুষ, দলছুট, বোহিমিয়ান, এলেবেলে। তখন থেকেই আমি মনে করেছিলাম, আমার নিজের অনেক কথা আছে, সেসব বলার জন্য আমার একটা মাধ্যম দরকার। কাগজে ফুটিয়ে তুলব আমার আবেগগুলোকে। আমি গল্পের বই পড়তাম। বইয়ের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতাম, কথা বলতাম। তারপর আমি পত্রমিতালি শুরু করলাম। প্রচুর চিঠি লিখতাম আমি এবং চিঠিও পেতাম। তারপর শুরু হলো পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখা। এর সবই আমার নিজের যে অনেক কথা আছে, সেসব বলার চিঠিপত্রের আশ্রয় নিয়েছি এক সময়।
লেখালেখির জন্য আমি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। আমি বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছিলাম লেখকদের সামনে থেকে দেখব এবং আমি নিজেও লিখব—এই আশায়। এই যেমন লেখালেখি আছে বলে আমার বিদেশ জীবনটা কিছুটা হলেও স্বস্তির হয়েছে। তবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। দেশে যখন থাকি, মনে হয় একটা মুক্ত আকাশের নিচে আছি। কিন্তু বিদেশে নানা কিছু করতে হয়। চাকরি, বাজার করা, বিল পরিশোধ, বাড়ির মর্টগেজ, গাড়ির ইন্স্যুরেন্স আর লোকজনের সঙ্গে মেকি হাসা, আলগা বন্ধুত্ব। বেশির ভাগ লোকই জেলাস! তাই সব সময় ‘অ্যাট হোম ফিলিং’ ব্যাপারটা থাকে আমার।
আমার যারা পাঠক, আমার লেখা যারা পছন্দ করেন বা যারা আমার বই কেনেন, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। পাঠকদের আবেগ বা আমার প্রতি তাদের ভালোবাসার সঙ্গে আমিও একাত্ম হয়ে যাই। আমি জানি, এতখানি পাওয়ার যোগ্য আমি না, আমি আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি। আমি হারিয়েছি যত, পেয়েছি তার বহুগুণ। বইমেলার সময়টা সব সময় চমৎকার। একটা মিলনমেলা। লেখক যেমন তেমনি মুগ্ধ পাঠকদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা সব সময় আনন্দের।