মেধাভিত্তিক অভিবাসন প্রস্তাব এক নতুন চাল

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার জন্য নতুন অভিবাসন পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। ১৬ মে হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি নতুন এ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন, যেখানে মেধাভিত্তিক অভিবাসনের কথা বলা হয়েছে। নতুন এ পরিকল্পনা অনুযায়ী উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, পেশাজীবী ও গবেষকদের জন্য আমেরিকার দরজা অবারিত হবে। কিন্তু এ প্রস্তাবে ‘ড্রিমার’ খ্যাত তরুণ অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বিষয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি প্রেসিডেন্ট। যদিও এই তরুণ অনিবন্ধিত অভিবাসীদের অধিকাংশই উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন।
নতুন প্রস্তাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প মেধাভিত্তিক অভিবাসনের কথা বলার পাশাপাশি মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কথা বলতেও ভোলেননি। প্রেসিডেন্ট এমন একটি অভিবাসন পদ্ধতি

চালু করতে চান, যা ‘আমেরিকানদের মজুরির সুরক্ষা’ দেওয়ার পাশাপাশি ‘আমেরিকান মূল্যবোধ ও অভিবাসীদের অধিকার সমুন্নত’ রাখবে। একই সঙ্গে সারা বিশ্ব থেকে মেধাবীদের আকৃষ্ট করবে। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবকে একটি বিরাট ‘ভাঁওতা’ হিসেবে দেখছে বিরোধী ডেমোক্র্যাট শিবির। এমনকি এটি তাঁর নিজ দলের অনেক রক্ষণশীলকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট নেতা ও স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তো বলেই দিয়েছেন, ‘এই প্রস্তাব প্রতিনিধি পরিষদে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হবে।’
বরাবরের মতোই ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন প্রস্তাব এক নতুন বিতর্কের সূচনা করেছে। তিনি একদিকে মেধাভিত্তিক অভিবাসনের কথা বলছেন অন্যদিকে ডিফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালসকে (ডাকা) নিরুৎসাহিত করছেন। রোজ গার্ডেনে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে গৃহীত এ প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া ড্রিমারদের নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। অথচ ২০১৭ সালে তাঁর প্রশাসনের বাতিল করা এ কর্মসূচি আমেরিকার অভিবাসন বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। তিনি দক্ষতাভিত্তিক অভিবাসনের মাধ্যমে আমেরিকাকে সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও, এই উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ড্রিমারদের ভাগ্যের বিষয়ে উদাসীন। একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যে কঠোর নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সীমান্তে যে অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও তিনি তেমন কিছু বলেননি।
আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, নিজ দেশে জীবন সংশয় বা অন্য কোনো কারণে হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো দেশ থেকে এগিয়ে। কারও আশ্রয় প্রার্থনার পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকলে, তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেওয়া হবে। কিন্তু প্রমাণে ব্যর্থ হলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে।
আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে ট্রাম্পের এই বক্তব্যকে আপাতভাবে উদার মনে হলেও, তিনি আদতে আগের অবস্থানেই রয়েছেন। কারণ মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের বিষয়টি তাঁর বক্তব্যে বরাবরের মতোই বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে গৃহীত বিভিন্ন কঠোর নীতির বিষয়ে তিনি একেবারে নিশ্চুপ। ফলে মুখে তিনি যা-ই বলুন না কেন, আদতে তিনি আগের অবস্থানেই রয়েছেন বলে মন্তব্য করা হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
প্রেসিডেন্ট নিজেও জানেন তাঁর এ প্রস্তাব কংগ্রেসে পাস হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আর এ কারণেই তিনি প্রস্তাবটি এবার না পারলে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর পাস করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘এবার যদি তারা এটিকে আটকে দেয়, তবে আগামী নির্বাচনে উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর আমরা নিজেরাই এটি পাস করে নেব।’
তাঁর এ বক্তব্যের সময় এ প্রস্তাবের অন্যতম নির্মাতা জ্যারেড কুশনার ও স্টিফেন মিলার ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ এ দুই নেতাই ভীষণভাবে অভিবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিত। মিলার সম্পর্কে সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা চাক শুমার বলেন, ‘যখন স্টিফেন মিলারের মতো একজনের হাতে আপনার অভিবাসন প্রস্তাবটি তৈরি হয়, তখন তা অবধারিতভাবেই ব্যর্থ হবে বলা যায়।’ চাক শুমার অবশ্য ট্রাম্পের প্রস্তাবটি উত্থাপনের আগেই এ মন্তব্য করেছিলেন।
ডেমোক্রেটিক দল প্রেসিডেন্টের নতুন এ প্রস্তাব নিয়ে প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়াই জানাক না কেন, তা সত্যি উত্থাপিত হলে ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা হলেও বিপদে পড়বেন। কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন এ প্রস্তাবের খোলসটি চমকদারি। মনে হবে, ন্যায্য কথাই বলছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সত্য হচ্ছে, প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এমনকি রিপাবলিকান ভোটারদের একটি অংশও তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানেই প্রচুর অবৈধ অভিবাসী কর্মী থাকার কথা চাউর হওয়ায় প্রেসিডেন্ট নতুন এ কৌশল নিয়েছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য প্রশাসনের ওপর পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে প্রশমিত করে আগামী নির্বাচনে আরেকটি লোকরঞ্জনবাদী ঢেউ তোলা। না হলে তিনি অভিবাসন সমস্যার গোড়ার দিকে তাকাতেন। তাঁর প্রস্তাবে ড্রিমারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন না। তাই এই প্রস্তাবকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরেকটি ‘ভাঁওতা’ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে যে উদ্দেশ্যেই তিনি এ চালটি চালুন না কেন, তাঁর এ প্রস্তাবই আমেরিকায় অভিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তার প্রাথমিক স্বীকৃতির প্রমাণ বহন করে। একই সঙ্গে এটি বর্তমান প্রশাসনের সর্বাত্মক অভিবাসনবিরোধী অবস্থানের অন্তঃসারশূন্যতাকেও তুলে ধরে। এ বিষয়টিকে কাজে লাগাতে পারে ডেমোক্র্যাটরা। বিশ্লেষকদের মতে, ডেমোক্র্যাটদের উচিত হবে দক্ষতাভিত্তিক অভিবাসনের প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে, তার ফাঁকগুলো বন্ধ করা। এই প্রস্তাবের বিরোধিতার কারণগুলো সম্পর্কে নিজেরা নিশ্চিত হওয়া। একই সঙ্গে ডাইভার্সিটি ভিসা (ডিভি) লটারি বাতিলের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা। দক্ষতার প্রসঙ্গটি সামনে আনায় তাদের হাতে এখন বড় অস্ত্র রয়েছে, যা দিয়ে ড্রিমার প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সীমান্ত নিরাপত্তার প্রসঙ্গটিকে স্বীকার করে নিয়ে তা উন্নত করার পাশাপাশি একটি মানবিক আমেরিকা গড়ার ডাক দিতে পারে ডেমোক্র্যাটরা। তাহলে ট্রাম্পের নির্বাচন পূর্ববর্তী চতুর এ প্রস্তাব অনেকটাই ধরাশায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত ডেমোক্র্যাটদের উচিত ট্রাম্পের ‘ভাঁওতা’টিকে সবার সামনে উন্মোচিত করে দেওয়া। তা না হলে ওই ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’-এর দোহাই দিয়ে ট্রাম্পই আবার বিজয় পতাকা তুলে ধরবেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প নেতৃত্ব দিয়েছেন এই শক্তিতেই।
নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকার আনুমানিক ২ কোটি বৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্বের জন্য একটি কার্যকর প্রস্তাব হাজির করতে হবে ডেমোক্র্যাটদের। অবৈধ অভিবাসন নিয়ে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা, আমেরিকানদের কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে সুস্পষ্ট প্রস্তাব হাজির করতে হবে। শুধু আমেরিকার বৈচিত্র্য রক্ষার ডাক এবারও হয়তো হালে পানি পাবে না। কারণ চীনের সঙ্গে এরই মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ইরানসহ বিভিন্ন ইস্যু এমনভাবে হাজির করা হচ্ছে, যা মার্কিন জাতীয়তাবাদের পালে জোর হাওয়া লাগে। এসবই করা হচ্ছে নির্বাচন সামনে রেখে। তাই ওই নির্বাচনের খেলাটি বুঝেই এগোনো প্রয়োজন ডেমোক্র্যাটসহ অভিবাসী অধিকার আদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের।