কুয়াশা থেকে সুপেয় জল!

নিজাম উদ্দিন
নিজাম উদ্দিন

প্রকৃতি দিন দিন রুক্ষ হচ্ছে। মরুকরণে বিশ্বের একটি বড় অংশ আক্রান্ত। একটি বড় অংশে রয়েছে সুপেয় পানির অভাব। কিন্তু আবহাওয়া যতই শুষ্ক হোক না কেন বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকেই। তাই বায়ুমণ্ডলের বিশাল পানীয় জলের ভান্ডারের দিকে বিজ্ঞানীদের চোখ অনেক আগে থেকেই। বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে সুপেয় পানি উৎপাদনে বেশ কিছু সাফল্য এরই মধ্যে ধরা দিয়েছে মানুষের হাতে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সাফল্যটি ধরা দিয়েছে বাংলাদেশি গবেষক নিজাম উদ্দিনের হাতে।

কুয়াশা থেকে পানি উৎপাদনের প্রযুক্তি মানুষ প্রথম উদ্ভাবন করে গত শতকের আশির দশকে। কানাডার কুইবেকে একটি বড় ক্যানভাস স্থাপনের মাধ্যমে প্রথম সফলভাবে বড় পরিসরে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। পরে আরও অনেকেই নিয়ে আসেন নতুন নতুন প্রযুক্তি। মূলত মরু অঞ্চলে প্রাণের সঞ্চারের দিশা নিয়ে হাজির হয় প্রযুক্তিটি।

বিজ্ঞানীরা বরাবরই প্রকৃতিকে নিজের শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করেন। যেকোনো সংকট থেকে উত্তরণে কিংবা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মানুষ প্রকৃতি থেকে সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন। ফগ হারভেস্টিং বা কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের এ প্রযুক্তিটিও মানুষ আয়ত্ত করেছে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, আবহাওয়া যতই শুষ্ক হোক না কেন, মরু অঞ্চলে ঠিকই কিছু গাছ বেঁচে থাকে। আর এই গাছ নিজের জন্য পানি সংগ্রহ করে বাতাস থেকেই। এ থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রথম বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানী বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন। কেউ এ ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম তন্তুর পৃথক একাধিক তল ব্যবহার করেছেন, কেউ ব্যবহার করেছেন ন্যানো প্রযুক্তি। বিষয়টির সাফল্য অনেক আগে ধরা দিলেও সংগৃহীত পানির পরিমাণ ও বিশুদ্ধতাই ছিল মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নিজাম উদ্দিন অনেকটাই সফল।

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কুয়াশা থেকে ন্যানো প্রযুক্তির সুপেয় পানি সংগ্রহে সক্ষম হয়েছেন নিজাম উদ্দিন। তাঁর এ প্রযুক্তি মরু অঞ্চলে বিশেষভাবে কাজে লাগবে বলে তিনি আশাবাদী। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সহকারী অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন ন্যানো প্রযুক্তিতে উচ্চতর গবেষণার জন্য কানসাস উচিটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে বৃত্তি নিয়ে আসেন। সেই সময় থেকে আমেরিকা, সৌদি আরব, ভারত ও বাংলাদেশের একদল গবেষক কুয়াশা থেকে সুপেয় পনি সংগ্রহের জন্য নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গবেষণা পাগল মেধাবী মুখ নিজাম প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে তাঁর গবেষণায় পাওয়া বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, এক মিটারের এক বিলিয়ন (১০০ কোটি)ভাগের এক ভাগকে ন্যানোমিটার বলা হয়। এই অতি ক্ষুদ্র কণা পর্যায়ের প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে এক বিরাট সম্ভাবনা। ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে বাটারফ্লাই ড্রোনের মতো ধারণা, যে প্রজাপতি পৃথিবীর সব সীমানা পাড়ি দিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে; সংগ্রহ করবে সব অজানা রহস্য। এটিই হলো সেই ন্যানো ম্যাজিক, যা বিশ্বকে বদলে দেবে নিশ্চিত। এই প্রযুক্তির হাত ধরেই সামনে এসেছে কুয়াশা থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহের নতুন সম্ভাবনা।

গবেষণাকাজে মেধার স্বাক্ষর রাখায় বাংলাদেশি এই গবেষক কানসাস উচিটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালের সেরা রিসার্চ ফেলোশিপ ও আউটস্ট্যান্ডিং ডকটোরাল গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নিজের কাজ সম্পর্কে নিজাম উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির অভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অথচ বায়ুমণ্ডলে ১০ লাক কোটি টনের বেশি পানি জমা রয়েছে। এই পানি সংগ্রহ করা গেলে এক বড় পরিবর্তন আসবে পৃথিবীতে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে তৈরি এক ফুট সুপার হাইড্রোফোবিক/ সুপার হাইড্রোফিলিক ন্যানো ফাইবার দিয়ে কুয়াশা থেকে সুপেয় পানি পাওয়া যাবে। এর আগে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হলেও নতুন এ প্রযুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ এটি সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে। এক ডলারের কম দামে দুই-তিন লিটার সুপেয় পানি পাওয়া যাবে এ পদ্ধতিতে। তাই এটি অনেক আকর্ষণীয়।

চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যাপ ভার্ডি, চীন, দক্ষিণ ইয়েমেন, ওমান, মেক্সিকো, কেনিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র অভাব রয়েছে। গবেষণার তথ্যমতে, এখন এসব দেশের বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান জলীয় বাষ্প থেকে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি সংগ্রহ করা যাবে। দেখতে উঁচু-নিচু ন্যানো পার্টিকেল দিয়ে তৈরি ফ্যাব্রিক্সের ন্যানো পোরাস স্ট্রাকচারের (অতিক্ষুদ্র ছিদ্র) সংস্পর্শে কুয়াশা এলেই তা সঙ্গে সঙ্গে ন্যানো ফিল্টারে জীবাণুমুক্ত হয়ে সুপেয় পানি উৎপন্ন করবে। এ পদ্ধতিতে প্রতি এক ফুট ন্যনোফিল্টার থেকে পাওয়া যাবে দুই থেকে তিন লিটার পানি।

গবেষণামূলক কাজে নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে এরই মধ্যে নিজাম উদ্দিন ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। বর্তমানে টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আমন্ত্রণে তিনি জাপানে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি ন্যানো প্রযুক্তিতে উচ্চতর গবেষণার নানা দিক নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জানান, মানুষের কল্যাণে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ এক বিশাল অর্জন। পরীক্ষাগারে সাফল্যের পর এখন এটি বাস্তব পরিবেশে বাস্তবায়নের প্রতীক্ষায় রয়েছে।