গর্ভপাত নারীর অধিকার

মেয়েটির নাম ফিওনা। প্রায় আড়াই বছর ধরে সে আমার ছেলের হোম অ্যাটেনডেন্টের কাজ করছে। প্রায় প্রতিদিনই বাসায় আসায় অনেকটা পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে গেছে সে। ফিওনার স্বামী ও ছোট্ট দুই সন্তান গায়ানার জর্জটাউনে থাকে। তিন বছর আগে স্বামী-সন্তানদের ছেড়ে মা-বোনদের সঙ্গে আমেরিকায় আসে ফিওনা। ওর তিন মাস বয়সী ছেলেকে স্বামীর কাছে রেখে চলে আসে এই দেশে। ওর স্বামী দেড় বছর ও তিন মাসের সন্তানকে একা লালনপালন করে বড় করছে। ফিওনা এখানে এসে প্রথম প্রথম খুব কাঁদত। টাকা জমিয়ে এক বছর পর স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে গায়ানায় যায় সে। এক মাস ওখানে থাকার পরে আমেরিকায় এসে ফিওনা জানতে পারে, সে আবার গর্ভধারণ করেছে। এখন কি করবে সে? স্বামী ও স্ত্রী দুটি আলাদা দেশে থাকে। ফিওনার আয়ের ওপর ওর স্বামী-সন্তানেরা নির্ভরশীল। তদুপরি মানসিকভাবে সে সন্তান নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়! এই পরিস্থিতিতে ফিওনার কাছে গর্ভপাত করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

হ্যাশ ট্যাগ ‘ইউ নো মি’। আমেরিকায় নতুন এক আন্দোলনের নাম। যেটা আমেরিকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এখন সারা পৃথিবীতে। আন্দোলনের প্রতিপাদ্য হলো অ্যাবরশান বা গর্ভপাত করার অধিকার কেন পাবে না নারী! আলাবামা-জর্জিয়াসহ আমেরিকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার কারণে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। যার পক্ষে–বিপক্ষে গড়ে উঠেছে নানা মত। প্রগতিশীলরা গর্ভপাতের পক্ষে। আর রক্ষণশীলরা বিপক্ষে। চলতি বছর ১৫ মে আলাবামার রিপাবলিকান গভর্নর কে আইভি যেকোনো ধরনের ‘গর্ভপাত’ নিষিদ্ধ করার পক্ষে আইন পাস করেন। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ৯৯ বছর পর্যন্ত জেল। এত কঠিন আইন এমনকি সৌদি আরবেও নেই। সৌদি আইনে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ নারীদের গর্ভপাতের সুযোগ আছে।

ডেমোক্রেটিক পার্টির দাবি, গর্ভপাতবিরোধী এই আইন আমেরিকার সংবিধান পরিপন্থী। অনাগত সন্তানকে, একটি তাজা প্রাণকে গর্ভে হত্যা করার অধিকার কোনো মায়ের নেই। কিন্তু কিছু পরিস্থিতিতে মাকে একান্ত বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যদি গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়, তবে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানকে সুন্দর একটি পৃথিবী উপহার দিতে না পারলে, কী মূল্য থাকে তাকে জন্ম দেওয়ার!

ধর্ষণ কিংবা অবৈধ সম্পর্কের কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীর পক্ষে কি সম্ভব তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার? স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আচরণ সহিংস হলে সেই মায়ের কি উচিত হবে ভয়ংকর পরিবেশে সন্তানকে জন্ম দেওয়ার? কিংবা স্বামী-স্ত্রী দুজনের সম্পর্কই ভালো, তারা ‍দুজনেই সন্তান নেওয়ার জন্য আর্থিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়, তখন তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে! এমন অনেক ইস্যুতে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সিএনএন হ্যাশ ট্যাগ ‘ইউ নো মি’–এর মাধ্যমে কয়েকজন নারীর কথা বলেছে। শুরুতে যেমন ফিওনার কথা শুনলাম, এখন শুনি তাদের কথা।

সন্তান ধারণের তিন মাসের সময় এরিকা গোল্ডব্যাট হেইট জানতে পারেন, তাঁর সন্তানের অবস্থা গুরুতর, সে হয়তো পুরো সময় পার করতে পারবে না মায়ের পেটে। এরিকার ছিল ওটা প্রথম সন্তান। বাচ্চাটি কনজেনিটাল হাই এয়ারওয়ে অবস্ট্রাকশন সিনড্রোমে ভুগছিল। কারণ তাঁর শ্বাসনালি ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। শিশুটির ক্রোমোসোনাল অ্যাবনরমালিটি থাকার কারণে সে সম্ভাব্য মিসক্যারেজের দিকে যাচ্ছিল। এরিকা আর তার স্বামী ফেটাল বা ভ্রূন বিষয়ক সার্জনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন। যেসব শিশু এই ধরনের সিনড্রোম নিয়ে জন্মায়, তাদের জন্মের পরপরই অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু তাদের সন্তানের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। ডাক্তাররা জানায়, শিশুটি যদি হার্টফেল করে মায়ের গর্ভে মারা যায়, তাহলে সে ব্রেইন ডেড হয়ে জন্মাতে পারে। নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এরিকা ও তাঁর স্বামী অবশেষে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১২ সালে এরিকা অবশেষে যখন গর্ভপাত করায় তখন সে ২০ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। আট ভাগ গর্ভপাত ঘটে ১৪ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে। এই তথ্যটি জানিয়েছে ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। ওই গর্ভপাতের ঘটনার পরে চলে গেছে সাত বছর, এরিকা এখন তিন সুস্থ শিশুর মা। যেসব মায়েরা এ ধরনের সংকটময় পরিস্থিতিতে গর্ভপাত করতে বাধ্য হন, তাদের জন্য এখন মাঝেমধ্যে কাউন্সেলিংয়ের কাজ করেন এরিকা।

গর্ভপাত নিয়ে কেন এত ভুল বোঝাবুঝি? এখন কোনো দম্পতি যদি মনে করেন, তারা এখন সন্তান নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই, তবে তারা কি করবেন? যেমন দুই সন্তানের এক মা তৃতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হলেন, কিন্তু সে আর স্বামী আলোচনা করে দেখল, এখন তাদের যে রকম আর্থিক অবস্থা, তাতে তৃতীয় সন্তান নেওয়া ঠিক হবে না। ওই নারী নিজের নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছে, ‘আমার পরপর দুই মেয়ে হয়েছে। এরপর তখনই তৃতীয় সন্তান নিলে নিশ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থা থাকত না। আমরা সত্যি নিশ্চিত ছিলাম না, আরও বেশি সন্তানের যত্ন করতে পারব কিনা!’ অনেক পরে এই দম্পতি একটি পুত্র সন্তান নেয়, যখন তারা আরেকটি শিশু নেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল।

অনেকের মনে বদ্ধমূল ধারণা থাকে, গর্ভপাত করলে পরে মা হতে গেলে নানা জটিলতা দেখা যায়। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এটা সম্পূর্ণ ভুল। গর্ভপাত করেছেন এমন নারীদের অধিকাংশই পরে মা হয়েছেন। আমেরিকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা গর্ভপাত করান। বিবাহিতদের ক্ষেত্রে এই হার খুব কম। ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, একটি সন্তান আছে এমন মায়েরা গর্ভপাত করেছেন, তার হার শতকরা ৮৫ ভাগ। আর দুই থেকে তিনটি সন্তান আছে এমন মায়ের সংখ্যা ১৪ ভাগ।

অবিবাহিতা নারীরা কেন বেশি গর্ভপাত করে? অনেক সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ঠিকভাবে কাজ না করায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে তারা। তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না একা একটি শিশুকে লালনপালন করে বড় করার। গর্ভপাত বিতর্ক নিয়ে চলমান ইস্যুতে ক্যাসি ডুরান নামে ২৬ বছর বয়সী এক তরুণী জানান, ‘এমন নয় যে, আমি ধর্ষিতা হয়েছিলাম বলে গর্ভপাত করেছি। নিরাপদ যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে। আমার সঙ্গী জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সেটা যেকোনো কারণে কাজ করেনি।’

ক্যাসি ডুরান একটি অফিসে অভ্যর্থনাকর্মী হিসেবে কাজ করেন, যেখানে তিনি সর্বনিম্ন মজুরি হিসেবে ঘণ্টায় মাত্র ১৫ ডলার করে পান। এই নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যদি নিরাপদ গর্ভপাতের সুযোগ না থাকত, তাহলে আমার জীবন কত সংকটময় হতো আমি ভাবতে পারছি না। সন্তানকে দেখাশোনার জন্য আমাকে একজন বেবি সিটার রাখতে হতো। সর্বনিম্ন মজুরিতে যেটা আমার পক্ষে খুব কঠিন হতো।’

এ তো গেল, পরিকল্পিত গর্ভপাতের কথা! কিন্তু যে সব মেয়েরা পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্যে বড় হয়ে ওঠে এবং নিজের অজান্তে উচ্ছৃঙ্খল জীবন বেছে নেয়, তারা যখন মা হয়, তখন সেই সন্তানকে একই রকম দুর্ভাগ্য বহন করতে হয়। কেইট পেয়ান তেমনই একজন। কেইটের যখন জন্ম হয়, তখন ওর মা–বাবার বয়স যথাক্রমে ১৭ ও ১৮ বছর। ওর জন্মের পর তারা বিয়ে করে। এবং দ্বিতীয় জন্মদিনের সময় আবার তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। কেইট তাঁর শৈশবের কথা বলতে গিয়ে জানায়, ‘শৈশব থেকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে আমি বড় হয়েছি। আমার বাবা-মায়ের সারাক্ষণ ঝগড়া লেগে থাকত। আমার বাবা শারীরিকভাবে মাকে নির্যাতন করত। যে কারণে বেশির ভাগ সময় আমাকে দেখে রাখতেন আমার নানি আর এইটথ গ্রেড পর্যন্ত পড়াশোনা করা আমার সিঙ্গল মা।

কেইটের বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর, তখন সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এক মাস প্রেম করার পর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে নাইটক্লাবে যায়, সেখানে অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানের পরে দুজনের যৌন সম্পর্ক হয় এবং সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। পরে সেই সন্তানকে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেয় কেইট। এ নিয়ে সে লিখেছে, ‘সন্তান ধারণ, মানসিক-শারীরিক অত্যাচার এবং দারিদ্র্য—এই চক্রের মধ্যে আমি বড় হয়ে উঠেছি। আমি চাইনি আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও এটা ঘটুক। যে কারণে আমি গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত নিই।’