দুই পক্ষের জটিলতায় অনিশ্চিত নির্বাচন

আবদুর রব চৌধুরী,আবু আহমেদ,নুরুল আমিন
আবদুর রব চৌধুরী,আবু আহমেদ,নুরুল আমিন

নিউইয়র্ক নগরের ব্রুকলিনের কেনসিংটনে বাংলাদেশি জনসমাজে রয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। একই সঙ্গে এসব সংগঠনে রয়েছে বিরোধ আর বিভক্তি। এ রকমই একটি সংগঠন সিএমবিবিএ (চার্চ ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন)। চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনের নির্বাচনকে ঘিরে দুই পক্ষের বিরোধ এখন প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।

আগামী ১৬ জুন সিএমবিবিএর নতুন কমিটির নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্মাণব্যবসায়ী নুরুল আমিনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছে আবদুর রব চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি। কমিশনের আরও দুজন সদস্যকে নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে, সংগঠনটির এই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠনের সদস্যরাই।

দুই বছর আগেও সংগঠনের কার্যকরী কমিটির নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষ ছিল। একপক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে গঠনতন্ত্র সম্মত নয় বলে আলাদা কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সে কমিটির কার্যক্রম খুব বেশি দূর যায়নি। সম্প্রতি সেই অংশ আবার সক্রিয় হয়ে সিএমবিবিএর পাল্টা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে হবে কিনা, এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেন, ক্ষমতার লড়াই

চলছে সিএমবিবিএতে। যে যার পছন্দের লোক টানছেন। ফলে, সংগঠন না দাঁড়িয়ে বিভক্তি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁর মতে, এ এলাকায় বাংলাদেশিদের যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে গোড়াপত্তন করেছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করা উচিত। তাঁদের পরামর্শ নেওয়া হলে সিএমবিবিএতে এত ঝামেলা থাকবে না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, নির্মাণ ব্যবসায়ীদের সিএমবিবিএর সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই কেন? সদস্যদের মতামত জানার জন্য সাধারণ সভা হয় না কেন? নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও সদস্য বানানো ও পুরোনো সদস্যদের নবায়নের বিষয়ে এখনো সময় নেওয়া হচ্ছে কেন?

সিএমবিবিএর অচলাবস্থা পুরোনো। কয়েক বছর নির্বাচন হয়নি। সংগঠনের সাধারণ সভা, বিশেষ সভা কোনটিই হয়নি। বরং সময়ে সময়ে মেলা এবং আরও নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে সেগুলো আত্মসাতের অভিযোগ আছে কোন কোন ব্যবসায়ী নেতার বিরুদ্ধে। এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে, নির্বাচনের পথেই হাঁটছে আবদুর রব চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি। কিছু সদস্য দাবি তুলেছেন, নির্বাচন পিছিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির কাজটি যেন আগে করা হয়।

সদস্যদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে, ‘সিএমবিবিএতে নেতার সংকট নেই। সংকট নেতৃত্বের। কাজ করার মানুষের। সবাই কথা বলেন। কাজ করার লোক কম। এর আগের কমিটি প্রায় ছয় বছর দায়িত্বে থাকলেও সেখানে সক্রিয় ছিলেন এক/দুজন। অথচ, নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরব হয়ে ওঠেন সবাই।’

বিগত কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ লিয়াকত আলীর বক্তব্যও প্রায় একই রকম। তিনি যোগ করেন, ‘আড়ালে অনেকে অনেক কিছু করবেন। সেদিকে নজর দিতে চাই না। ব্যবসায়ীদের সংগঠনে তাদেরই স্বার্থরক্ষা করা হবে, তাঁরাই নেতা হবেন—এটিই আমার চাওয়া’। বর্তমান নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন মোহাম্মদ লিয়াকত আলী।

কোনো পক্ষভুক্ত নন, এমন একজন সদস্য বললেন, ‘আমাদের নেতারা সম্পর্ক দেখে কাজ করেন। নির্বাচন কমিশন গঠন, কমিটি গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ আর দায়িত্ব দেওয়া হয় খাতিরের লোকজনকে। সংগঠন দেখে না কেউ। এখানে সংগঠন মানে কর্তৃত্ব আর সম্পর্ক।’ তাঁর পরামর্শ, ‘গঠনতন্ত্র পাল্টানো দরকার। টানা দুবার কেউ দায়িত্বে থাকতে পারবেন না, এমন ধারা যোগ করা দরকার। নির্মাণ ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার’।

এ প্রসঙ্গে সিএমবিবিএর সভাপতি আবদুর রব চৌধুরী দাবি করেন, ‘এখানে কিছু সদস্য কেন অসন্তুষ্ট আমার নিজেরও প্রশ্ন। সবার সঙ্গে বৈঠক করে আমাদের কমিটি গঠিত হয়েছে। সেখানে সবাই উপস্থিত থেকে মত দিয়েছেন। কমিটি গঠিত হওয়ার পর দু/একজন সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কিন্তু, তারা সে বিষয়ে আমাদের কখনো বলেননি। আগের কমিটি ৪টি পথ মেলা করেছে। মেলা থেকে আয় হয়েছে। এর বাইরে সংগঠনের তহবিলে আগের ২৬ হাজার ডলার আগের জমা ছিল। এর কোনো হিসাব নেই। অথচ আমাদের কমিটি একটা মেলা করে আয় করেছে ২৫ হাজার ডলার।’

নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে আবদুর রব বলেন, ‘সদস্যদের কেউ দাবি করলেই নির্বাচন পেছাতে হবে, আমি মনে করি না। কারও দাবি যুক্তিসংগত হলে ভেবে দেখা যেতে পারে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ—এসব গঠনতন্ত্র মেনে করা হয়েছে।’ নির্বাচন কমিশন পাল্টানোর সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আর নির্বাচন করছি না। আশা করছি, যারা আমার নেতৃত্বের বিরোধিতা করছেন, তারাও এসে নির্বাচনে অংশ নেবেন। একটা দক্ষ নেতৃত্ব পাবে সিএমবিবিএ’।

তবে আবদুর রব বিরোধী হিসেবে পরিচিত আবু আহমেদ অভিযোগহ করেন, ‘দুই বছর আগে সিএমবিবিএর সদস্যদের সম্মতিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও তারা গঠণতন্ত না মেনে নিজেদের পছন্দমতো আবদুর রব চৌধুরীকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে দেয়। বিরোধের সূত্রপাত তখন থেকেই।’

আবদুর রব বিরোধী পক্ষের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব, আদর প্রিন্টার্সের মালিক আবু আহমেদ বলেন, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড এলাকার ৫০–৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী তাদের সঙ্গে রয়েছেন। এদের উৎসাহে গেল ১৭ মে মোসাদ্দেক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সিএমবিবিএতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচনের প্রক্রিয়া বাতিল করে, সব সদস্যের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়া নুরুল আমিন মনে করেন, ‘সিএমবিবিএর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থাকা ঠিক নয়। তারা কোন একটি জায়গায় তাদের মতামত বা আপত্তি জানাতে হবে। নির্বাচন নিয়ে আপত্তি থাকলে, কেন বা কী কারণে, সেটা আমাকে জানালে হয়। আমরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে করণীয় ঠিক করতে পারি।

নির্বাচন কমিশন গঠন নীতিমালা অনুযায়ী হয়নি বলে তাঁর পদত্যাগের দাবি প্রসঙ্গে নুরুল আমিন বলেন, ‘বাতিল, পদত্যাগ এসবের কোন সুযোগ নেই। গঠনতন্ত্রের বাইরে কিছু হয়নি।’ নির্বাচন পেছানোর সুযোগ আছে কিনা, সবার অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সম্ভব। এজন্য এখানে কথা না বলে আমাকে বলুন।’