অসমাপ্ত কথন

২০১১ সালের ১১ জুলাইয়ের ঘটনা। আমি দেশ ছেড়ে বিদেশে যাচ্ছি স্বামীর কাছে আমেরিকায়। প্রতিবার বিদেশ যেতাম ঘুরতে, বেড়াতে। এবার যাচ্ছি সংসার করতে। মনের অবস্থা খুব একটা ভালো না। সারা জীবন যেখানে বড় হলাম, বেড়ে উঠলাম, সবাইকে ছেড়ে, সবকিছুকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি অজানা এক দেশে। সেই কষ্ট আমার মতো যারা বিদেশে সংসার করতে এসেছে, তাদের মনে হয় সবারই কম-বেশি জানা। একদিকে দুঃখ, অন্যদিকে নিজ সংসারে স্বামীর সঙ্গে থাকব সেই আনন্দও ছিল অনেক। মন ভালো-খারাপের দোলনায় দুলছিল। কেমন যে সেই সময়টুকু ছিল, লিখে হয়তো বোঝাতে পারব না। যখনই মনে হয়েছে আমার প্রিয় বাবার কবরটাও আর সহজে দেখতে পাব না, তখন চোখের পানি আটকে রাখা কষ্ট হচ্ছিল।
ছোট একটা ঘটনা, আমি একবার অস্ট্রেলিয়ায় যাব। একা যাব, আমার বড় বোনের ওখানে। বাবা আমাকে বিদায় দিতে বিমানবন্দরে এসেছিলেন। আমি লাগেজ বুকিং দিয়ে দেখি, বাবা নাই। কিছুক্ষণ পর দেখি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। শোনো এখন আর চিন্তা নেই, একজনকে পেয়েছি, সেও অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে। তুমি তার সঙ্গে ভালোভাবে যেতে পারবে। আমি শুধু তাকিয়ে শুনছিলাম। বললেন, আসো তোমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আমি গেলাম বাবার পিছু পিছু, দেখি বয়স্ক এক ভদ্র মহিলা। তাঁর পরিবারের সবাই এসেছে তাঁকে বিদায় জানাতে। কিছুক্ষণ গল্প হলো সবার সঙ্গে। গল্পে এক সময় জানতে পারলাম, ওই ভদ্র মহিলা অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন ঠিক, তবে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসে না, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে। বাবার মুখ দেখার মতো হলো। আমি খুব হাসছিলাম বাবাকে দেখে। আর বেশি সময়ও নেই উড়োজাহাজ ছাড়ার। বললেন, তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি। আমি দেখলাম দ্রুত কোথায় যাচ্ছেন। তাকিয়ে রইলাম তাঁর পথের দিকে। কিছুক্ষণ পর আবারও হাসি মুখ নিয়ে ফিরে এলেন রাজ্য জয়ের হাসি নিয়ে। দেখলাম এক ছেলে তাঁর সঙ্গে। বললেন, এ অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসে। সত্যি বাবা কে দেখে মনে হচ্ছে পুরো এক রাজ্য জয় করে এসেছেন। আমাকে একা যেতে হবে না। বাবারা মনে হয় এমনি হয়, যতই বড় হই না কেন তার কাছে ছোট আদরের বিড়াল ছানা।
খুব মনে হচ্ছিল বাবার কথা, উনি বেঁচে থাকলে হয়তো এবারও নিশ্চিত কাউকে না কাউকে খুঁজে নিয়ে আসতেন। স্মৃতি থেকে বের হয়ে, আমি মা আর আদরের খালাকে বিদায় দিয়ে উড়োজাহাজে গিয়ে বসলাম। কিছুতেই চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ছোট থেকে এই পর্যন্ত কত কথা মনে পড়ছিল, আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী, প্রাণের প্রিয় বন্ধু-বান্ধবীদের, রোজিকেও (আমার বাসার কাজের মেয়ে) মিস করতে লাগলাম। সেই কান্না যে কতটা কষ্টের বলে বোঝানো যাবে না। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এত মানুষের মাঝে সেটাও করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে জগা-খিচুড়ির মতো অবস্থা। এর মধ্যে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিচ্ছি আর ভাবছি আমার পাশের আসনে কে বসবে। তাকিয়ে বারবার দেখছি, কে আসে, একজন সাদা লুঙ্গি পরে বিশাল দেহের কালো একজনকে দেখতে পেলাম। ওই লোক আমার পাশে বাসবে এই ভাবনায় কান্না মনে হয় কিছু সময়ের জন্য বিদায় নিল। দেখি ওই লোক আমার আসন রেখে পেছনে চলে গেল। এত আনন্দ যেন ঈদের চাঁদ দেখলেও হয় না।
আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। দেখি এক মোটা মহিলা পান খেতে খেতে আসছে আমার দিকে। পানের গন্ধ আমার একদম সহ্য হয় না। আমি সকাল থেকে এমন কোনো খারাপ কাজ করিনি যে, আমাকে এমন শাস্তি পেতে হবে। নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা, উনি যখন আমার আসনের পাশে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলেন। আমি মহিলার কৃষ্ণচূড়ার মতো দাঁতগুলো দেখতে পেলাম। কেমন জানি খুব খারাপ লাগতে শুরু হলো। এয়ার হোস্টেস এগিয়ে এসে মহিলার টিকিট দেখে আমার পেছনের আসনে বসিয়ে দিলেন। আবারও ঈদের চাঁদ দেখলাম। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম আবার কে আসবে, এই ভেবে। দেখি কেউ আসছে না, কিছুক্ষণ পর উড়োজাহাজ ছাড়বে, মনে শান্তি শান্তি লাগছিল। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। আমি এতবার উড়োজাহাজ ভ্রমণ করেছি, এমন দৌড়াতে কাউকে দেখিনি। অবশেষে সে আমার আসনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। কোনো কথা বলার মতো অবস্থা নেই। আমি একটা পানির বোতল দিলাম। সে এক নিমেষে শেষ করে নিল। আর খুব আস্তে করে বলল, থ্যাংকস।
আমি বললাম, প্লেন ছাড়বে বসো। দেখে আমার চেয়ে অনেক ছোটই মনে হচ্ছিল। কিছুটা জড়তা নিয়ে বসল। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম, কেমন জানি জড়সড় হয়ে বসেছে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম, কী নাম তোমার, ওর নাম বলল। এইচএসসি পাশ করে লন্ডনে যাচ্ছে। ঢাকায় আজ প্রথম এসেছে বিমানবন্দরে। তারপর যাচ্ছে লন্ডন। বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মন খুব খারাপ। ওর মন খারাপ দেখে নিজের মন খারাপ অনেকটা ভুলে গেলাম। একটু পরে আমাকে বলছে, ‘আপু আমার অনেক ভয় লাগছে।’ আমি জানতে চাইলাম কেন। বলল, ‘আমি আগে কখনো প্লেনে উঠি নাই। এই প্লেন আকাশে উড়বে ভাবতেই খুব ভয় লাগছে। আপু আমরা পড়ে যাব না তো।’
ছেলেটির ভয়ার্ত চেহারা দেখে খুব মায়া লাগছে। আমি ওকে বললাম, আমার হাত ধরে বসো। কথাটা শুনে আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিল, মনে হয় বুঝতে পারেনি। আমি ওর হাত ধরে ওর সঙ্গে গল্প করা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন উড়বে, ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে আমি ওকে একটা ধমক দিলাম। বললাম, আশ্চর্য তোমাকে আমি হাত দিলাম তোমার যাতে ভয় না লাগে, আর তুমি আমার সঙ্গে এইটা কেন করলে। ওই ছেলে আমাকে বলছে, আমি কিছু করি নাই। আমার তো মেজাজ আরেকটু বেড়ে গেল। আমি খুব রাগ করে বলছিলাম, এ জন্য মানুষের উপকার করতে হয় না। আমাকে ও বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ও নাকি কিছু করেনি। আমি আড়চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, উড়োজাহাজ আকাশে উড়ছে। মুখটা প্রায় কাঁদো কাঁদো। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, তুমি কিছু করোনি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো। ও খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে৷ আমি ওর চেহারাটা দেখছিলাম, মনে হলো এক নিমেষে আকাশের সব অন্ধকার দূর হয়ে আলো ছড়াচ্ছে খুশির। ওর বুঝতে কষ্ট হয়নি, আমি কেন তখন ওকে ধমক দিয়েছিলাম। বাকি রাস্তা দুজনের গল্পে কেটে গেল। আমাদের দুজনের ট্রানজিট ছিল আবুধাবি। আমার ট্রানজিটের সময় ছিল খুব কম। ওর প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। আমি ওর কাছে বিদায় নিয়ে বোর্ডিং নিতে যাচ্ছি, দেখি ও আমার সঙ্গেই আসছে। বললাম, লন্ডনের প্লেন তো অন্যদিকে। বলল, আপু আমার দেরি আছে আপনার সঙ্গে যাই। মানা করলাম না। ভালো লাগল সত্যি খুব। নিজেকে একা লাগল না। আমার বোর্ডিং নিয়ে এবার সত্যি বিদায়ের পালা। দেখি, ও আমাকে একটা পাওয়ার গ্লাস দিচ্ছে ছেলেদের, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না, এটি ওর নতুন পাওয়ার গ্লাস। খুব শখ করে কিনে নিয়ে যাচ্ছিল, তারপরও আমি বলি কি এইটা? বলল, আপু এইটা আমি আপনাকে দিচ্ছি, আপনি মানা করবেন না, খুব সামান্য। আমার চশমা আমার ভালোবাসা হিসেবে রেখে দেবেন আপনার কাছে।
আমি খুব অবাক হলাম, অচেনা দুটি মানুষ কয়েক ঘণ্টার সম্পর্কে, একজন অন্যজনের বিদায়ে কষ্ট পাচ্ছি। প্রথমে নিতে রাজি না হলেও ওর ভালো লাগাকে সম্মান দেখিয়ে নিলাম। আমার নম্বর চাইল, আমার তখন আমেরিকার কোনো নম্বর ছিল না সেলফোনের। তাই আমার বরের নম্বরটা দিয়ে রাখলাম। চলে আসলাম উড়োজাহাজে করে আমার নতুন শহরে, আমার নতুন সংসারে। সে চলে গেল ওর স্বপ্নের শহর লন্ডনে। বেশ কিছুদিন পর ওর একটা ফোন এসেছিল, আমার সেলফোনে ওর নম্বর সেভ করলাম লন্ডন বয় নামে।