অক্ষম গন্তব্যে

ক্ষুধার তাড়নায় পেটে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। পাশে একটা মাঝ বয়সী লোক সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়চ্ছে। লোকটির যেন স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানটুকুও ও নেই! নিকোটিনের তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ ওর মেজাজ আরও সপ্তমে উঠল!
পকেটে শুধু লঞ্চের ভাড়াটাই আছে। চাকরিটা একরকম হাতছাড়া হয়ে গেল। সকালে বাড়ি থেকে পা বাড়ানো মাত্রই তিন বছরের মেয়েটার আবদার, ‘বাবা কলা।’ কী জানি! আজ সে কলার পাল্লায় পড়েছে কিনা! ওর হাতে পুরোনো দৈনিকের পৃষ্ঠায় মোড়ানো আটটি শবরি কলা। অনেক কষাকষির পর বারো টাকা দাম ধার্যে এই আটটি কলা কেনা গেল। লঞ্চের ভাড়া বাদে ওর কাছে অতিরিক্ত কানাকড়িটিও নেই এখন! খাঁ খাঁ রোদ। আকাশের দূর পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে কিনা ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে হলে ভালোই হতো।
যাত্রী বোঝাই লঞ্চটি চলছে তো চলছেই। কোথায়, কবে তার চলা শেষ হবে, এ সব ভাবনাতীত। তবে ওর বেকার জীবনের বিরামহীন এ চলা যেন নদীতে ভাসমান কচুরিপানার মতোই অজানা ঠিকানায় নিরন্তর ছুটে চলা। ওদিকে বাড়িতে সকলে তার পথ চেয়ে আছে। চাকরিটা কি তার হলো, নাকি হলো না বলে হয়তো ভাবনার জট পাকাচ্ছে সবাই। আর তার ছোট্ট মেয়েটা? বাবা তার জন্য কলা আনবে, নাকি ‘ভুলে গেছি; পরে এনে দেব লক্ষ্মীসোনা’, এসব বলে চোখের জল মুছিয়ে আদর করে ওকে কোলে তুলে নেবে—এসব ভাবছে তিন বছরের শিশুটি।
আপাতত লঞ্চের ডেকে কোনো চেনা মুখ নেই। নিজের অলক্ষ্যে কোনো এক গোপন ইশারায় ওর হাতের চঞ্চল আঙুলগুলো পুরোনো দৈনিকের মোড়কে চলে যায়। ওখানে আটটি কলা সযত্নে রক্ষিত। ওর মনে হলো, এইমাত্র বুঝি লঞ্চটি টার্মিনাল জেটি ছাড়ল। সামনে এখনো টানা লম্বা পথ...। অনেক সময়...। এমন সোনার চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে গেল! সে এখন নিজেকে বড় অসহায় ভাবে। ভাবে, এই ত্রিভুবনে ওর বিধবা বৃদ্ধা মা, বাড়ন্ত বোন, স্ত্রী এবং তিন বছরের শিশু কন্যা ছাড়া কেউ নেই। নিষ্ঠুর নির্দয় এ জগতে ও একেবারেই অসহায়!
আচ্ছা শবরি কলা জিনিসটা কি অতিরিক্ত মিষ্টি নয়? বেশ তো! মনে পড়ে, ও ছোটবেলায় কলা খেতে খুব পছন্দ করত। এ কলা খাওয়া নিয়ে সময়-সময় মায়ের হাতের পিটুনিও খেয়েছে, ভালো মনে আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা ওকে আর কলা খেতে দিতে পারেননি!
তো, প্রচণ্ড রোদে স্বাস্থ্যের পক্ষে কলা খুবই উপকারী। কলা সমস্ত দেহ মন ঠান্ডা করে দেয়। এতক্ষণে ওর ভেতরকার উটকো ভাবটা স্তিমিত হয়ে এল। আর এদিকে লোকটা বেকুবের মতো ধোঁয়া ছেড়েই চলেছে। খাও শা- ধোঁয়া! তোমাকে দেখিয়ে আমি বেশ কলা খাচ্ছি!
ওর মনে এখন বিভিন্ন সময়ে পড়া বেকার যুবকদের জীবন বিষয়ক গল্প উপন্যাস ইত্যাদির কাহিনি মনে হতে লাগল। এমনকি সিনেমায় দেখা বিপর্যস্ত বেকার যুবক কেমন করে আফিসে আফিসে ধরনা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। অবশেষে আত্মহত্যা ঘটিয়ে অনিশ্চিত জীবনের মঞ্চে যবনিকা টানছে। এসব চিত্র বাস্তব হয়ে তার চোখের সামনে ভেসে চলছে। এবং সবশেষে দুটো বিবদমান বিড়াল, চুরি করা একটি পিঠা এবং বাটখারা হাতে চতুর বানরের সেই গল্পটা মনে পড়ল।
...এবং এসব ভাবতে ভাবতে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, তার হাতে কলা বলতে কোনো লোভনীয় খাদ্যবস্তু নেই!
অবশেষে উজবুক সেই লোকটা সিগারেটের শেষাংশটুকু পায়ের নিচে পিষেই মারল! এতক্ষণে ওর মনে খুব দুঃখ হলো। কী দোষ ছিল মাত্র অতটুকু সিগারেটের!
সে মনে মনে খুব দুঃখিত হলো। কারণ ওর বারোটি টাকাই জলে গেল! আর এই বারো টাকা ভাঙার বিনিময়ে ওর খুকুর মুখে পাকা কলা দিতে পারেনি বলে ও খুবই লজ্জিত হলো। এ মুহূর্তে ওর স্বর্গত বাবার কথা মনে পড়ল। বাবা ওকে প্রায়ই কলা খেতে দিতেন। বাবা পরলোকে গমন করাতে সে এতিম হলো। কিন্তু, আজ সে নিজে পিতা হয়ে বেঁচে থাকতেও তার খুকুমণি কলা খেতে পারেনি। ‘কী দুর্ভাগ্য আমার খুকুর......!’ এসব ভেবে সে এখন বিলাপ করতে লাগল।
এবার মনে হলো লঞ্চ তার গন্তব্যে এসে গেছে। এখন রোদের সেই তীব্রতা নেই। সন্ধ্যার ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস ওর সারা শরীরে মিষ্টি শিহরণ ছড়িয়ে দিল। ‘হ্যাঁ নিষ্ঠুর নিয়তি! আমি কাউকে খুশি করতে পারলাম না!’ ওর দু’ চোখ থেকে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
এ সময় ওর মনে একটি প্রশ্নই বারবার দোলা দিতে লাগল, ‘আহা! খুকুর কাছে আমার চাকরির চেয়ে ওই আটটি কলার মূল্য কি অধিক নয়?’