লোকটির নাম মিলনের বাপ

পিরুর সমস্যাগুলো সব সময়ই অন্যরকম। এ মুহূর্তে সে নিউজার্সির হাডসন নদীর ধারে বসে কফি খাচ্ছে, আর অদ্ভুত সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবছে। স্টারবাকস থেকে পাঁচ ডলার পঁয়ষট্টি সেন্ট দিয়ে মকা কফি নিয়েছে। ক্যাফেইন আর সুগারে ঠাসা। কমপক্ষে পরবর্তী তিন-চার ঘণ্টার জন্য তাজা রাখবে। শহরের এ পাশটায় উবারের খেপ নিয়ে এসেছিল। সে থাকে হাডসন নদীর অন্য পাশে নিউইয়র্কের কুইন্সে।
কফি পানের মুহূর্তটা হওয়া উচিত ছিল রোমান্টিক। কিন্তু রোমাঞ্চ করার মতো পার্টনার তার এ মুহূর্তে নেই। রাশিয়ান মেয়ে ইউলিয়াকে সে খুব পছন্দ করে, কিন্তু সেটা ভালোবাসার পর্যায় পর্যন্ত যায়নি। উটাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে দুজনেই একসঙ্গে পাস করেছে। সেখান থেকেই পরিচয়। নিউইয়র্কে করপোরেট চাকরি নিয়ে পিরু প্রথমে চলে আসে। এক বছরের মাথায় ইউলিয়া উটাহর চাকরি ছেড়ে পিরুর কাছে নিউইয়র্কে চলে আসে; তবে থাকে আলাদা। লিভিং টুগেদারে পিরু বিশ্বাসী নয়। ইউলিয়া যদি তাকে সত্যিই ভালোবাসে, তাহলে একদিন এমনিতেই চলে আসবে। তখন বিয়ে করবে। আর সত্যিকারের ভালোবাসা যদি না-ই হয়ে থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে যতটুকু আছে ততটুকুও হারিয়ে যাবে। অবশ্য তাতে পিরুর কোনো আফসোস কিংবা তাড়া নেই। কফিতে চুমুক দিতে দিতে সে সূর্যাস্ত দেখছে।
সন্ধ্যা হয় হয় মুহূর্তটা পিরুর খুব ভালো লাগে। আকাশে কত রঙের মাখামাখি। তার ভেতর দিয়ে আবার গাঙচিল উড়ে যায়। যেতে যেতে কালো বিন্দু হয়ে হারিয়ে যায়। এ মুহূর্তে ইউলিয়া থাকলে হয়তো সে তার গা ঘেঁষে বসে পুরোনো দিনের গল্প করত। মুহূর্তটাকে উপভোগ্য করে তুলত।
পিরু পকেট থেকে হেডফোন বের করে গান শোনা শুরু করল। নাম না জানা কোনো এক শিল্পীর ইংরেজি গান—‘ওয়ানস আপন এ টাইম, আই ওয়াজ এ হিরো টু ইউ/ হে হে হে ইউলিয়া, ওহ ইউলিয়া/ ওয়ানস আপন এ টাইম...।’
আসলে গানের কথায় ‘ইউলিয়া’ শব্দটা ছিল না। পিরু ওটা বসিয়ে নিয়েছে। শুনতে ভালো লাগে। গান শোনা, আর দিগন্তে নিউইয়র্কের স্কাইলাইন দেখতে পিরু নিজেকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে চেষ্টা করল। কিন্তু ইতিমধ্যে তার মাথার ভেতর ভর করেছে অন্য একটা মানুষ। মাঝেমধ্যেই ভূতের মতো করে কিছু মানুষ তার মাথার ভেতর ঢুকে যায়। তারপর শুরু হয় চোর-পুলিশ খেলা। এ ক্ষেত্রে পিরু হয় চোর, আর ওই সব চরিত্র পুলিশ। সে যতই পালতে চায়, ততই পুলিশ তার পিছু নেয়। যেমন, এই মুহূর্তে তার মাথায় ভর করেছে বাংলাদেশের শৈশবে দেখা বৃদ্ধ মিলনের বাপ।
সে বহু বছর আগের কথা। ঢাকার মেরাদিয়া এলাকার কাছাকাছি থাকত মিলনের বাপ। এখনকার বনশ্রী। বয়স ষাট কি সত্তর হবে। পেশায় মুলি বাঁশের কারিগর বা কামলা। বাঁশ দিয়ে যেকোনো জিনিস বানাতে সে ছিল জিনিয়াস। সেই সময় মেরাদিয়া হাট থেকে কেনা পাকা বাঁশ কেটেকুটে নিখুঁত করে বেড়া, ঘরের ছাউনি, সিলিং, গেট ইত্যাকার জিনিস বানাত। একনামেই পরিচিতি ছিল সে। মিলনের বাপ; পুত্রের পরিচয়েই পিতার পরিচয়। তার অবশ্য কারণ ছিল। মিলন সেই সময়ে মেট্রিক পাস দিয়ে কলেজে পড়ে। ছোট্ট পিরুর কাছে এই খবর ছিল হা হয়ে যাবার মতো। সে তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ে। ম্যাট্রিক পাস করা ছেলের বাবা কমলার কাজ করে!
মিলনের বাপ মাঝেমধ্যে একটু রগচটা আচরণ করতেন। বিশেষ করে বাচ্চারা যখন তাঁর কাজে ব্যাঘাত ঘটাত। হয়তো বয়স আর কষ্টকর পেশার কারণেই। কুঁজো হয়ে বসে গভীর মনোযোগের সাথে সে সারা দিন কাজ করত। সন্ধ্যা হবার আগেই শীর্ণ শরীরে কালচে পড়া সাদা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে চলে যেতেন। তৃষ্ণা পেলে কখনো পিরু ঘড় থেকে পিতলের গ্লাসে করে পানি এনে দিত। মাঝেমধ্যে পিঠা পায়েসও।
পিরুর মাথায় যখন কেউ ভর করে বসে, তখন সবকিছুই ছারখার করে দেয়। ব্যস্ত জীবনের সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। ভর করা ভূত সারাক্ষণ আশপাশে ঘোরাফেরা করে। তার সাথে দিব্যি কথা বলে, কাজে বেরোয়, খাবারের সময় সঙ্গী হয়, ঘুমাবার সময় পাশের টেবিলে বসে গল্প করে। পিরু এ ব্যাপারে সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলতে চেয়েছিল। শেষমেশ যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
মিলনের বাপও পিরুর অদূরে বসে বসে নিউইয়র্কের স্কাইলাইন দেখছে। দুজনের মধ্যে কিছুটা সুনসান নীরবতা। পাশে একটু কোলাহল শোনা যাচ্ছে। একটা ম্যাক্সিকান ফ্যামিলি মাছ ধরছিল। বড়শিতে বড় একটা মাছ উঠেছে। সেটা নিয়ে তারা সেলফি তুলতে ব্যস্ত। মিলনের বাপ পিরুকে ইঙ্গিত করে প্রথমে কথা শুরু করল—
-পিরু বাপজান, এই নদীতে কী কী মাছ থাহে?
-চাচা, আপনি এখানে এলেন কী করে? পিরুর উৎসুক প্রশ্ন।
-মুরুব্বিরা প্রশ্ন করলে আগে উত্তর দিতে হয়। তারপর প্রশ্ন কইরেন। প্রশ্নের ওপরে প্রশ্ন করা বাজে অইভ্যাস।
-চাচা, অনেক ধরনের মাছ থাকে। নর্দান পাইক, ক্যাটফিশ, ওয়ালাই জাতীয়।
-চাচা, আপনি কত সালে যেন মারা গেলেন?
-তা, তো সাতাশ বছর হইবই।
-কীভাবে মারা গেলেন? আপনি কি শেষ পর্যন্ত মুলি বাঁশের কাজ করতেন?
-গরিবের আর মইরা যাওয়া। হাঁপানির ব্যারাম বাবা, ওইটাই আমারে নিল। বয়সও তো কম ছিল না। একে তো অভাবী, তার উপর ব্যারাম। বুজতেই তো পার।
-মিলনের কী খবর?
-হুনছি, অয় ভালো আছে। ইতালিতে থাহে; বউ-বাচ্চা নিয়া। নৌকায় কইরা গেছিল। ওর মা বাঁইচা থাকা পর্যন্ত ট্যাকা পাঠাইত। এহন তো আর আমরা বাঁইচা নাই। ট্যাকা পাঠানোর মামলাও শেষ।
-হুম
-তয় পিরু বাপজান, আপনি কেমন আছেন? শুনছি আপনের আব্বা-আম্মাও পরকালে চইল্যা গেছে। আল্লাহ তাগো বেহেশতে নসিব দান করুক।
-ঠিকই শুনেছেন। আর এই তো আমি আমেরিকায় থাকি। কাজ করি, খাইদাই, ঘুমাই। দেশে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন টাকা চাইলে পাঠাই। মাঝেমধ্যে জগৎ-সংসার নিয়া চিন্তা করি। ছোটবেলায় দেশের স্মৃতি স্মরণ করি। আপনাদের কথাও।
-আপনি কি আর দ্যাশো যাইবেন না? নাকি এই এমেরিকায়ই জীবন পার কইরা দিবেন?
পিরুর এর উত্তর জানা নেই। অনেকবারই নিজের কাছে উত্তর জানতে চেয়েছে, পারেনি। যতটুকু সময় সে বাংলাদেশ পার করেছে, তারও অধিক সময় সে এই আমেরিকায়। অবস্থান আর সময়ের হিসেবে আমেরিকাই তার দেশ। কিন্তু তবুও কিছু একটার শূন্যতা যেন তাকে পেয়ে বসেছে। কী সেই শূন্যতা, সেটাও তার জানা নেই। খাঁচায় পোষা টিয়ে নাকি মুক্তি পেলেও কখনো দলে ফিরতে পারে না। একাকী আকাশে উড়ে বেড়ায়। মুক্তির বিনিময়ে মিলে নিঃসঙ্গতা।
সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। স্কাইলাইনের সবগুলো সুউচ্চ দালান নতুন আলোতে জেগে উঠেছে। পিরু কফিকাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মিলনের বাপকে উপেক্ষা করে সে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করল। আর যাই হোক এই ব্যাটাকে গাড়িতে কিংবা বাসায় নেওয়া যাবে না। তার অনেক অনেক কাজ বাকি। এ মুহূর্তে মিলনের বাপের সাথে সখ্য করলে বিরাট সমস্যা হবে। দিনরাত প্যাঁচাল পাড়তে পাড়তে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল, পেছন ফিরে না তাকাতে। একবার যদি সে পেয়ে বসে, তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে তার অতীত, ভবিষ্যৎ নিয়ে ছারখার করে ছাড়বে। আগেও এ রকম সমস্যা হয়েছিল। প্রাইমারি স্কুলের কাশেম স্যার ম্যানহাটন স্টেশনে পিরুকে একদিন এই রকম পেয়ে বসেছিল। অথচ কাশেম স্যার মারা গেছেন বহু বছর হবে। পিরু দ্রুত হেঁটে তার গাড়ির দিকে যাচ্ছে। সে নিজের কাছে হার মানল। আড়চোখে পেছনে তাকাল। ছেঁড়া চপ্পল পায়ে, লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা মিলনের বাপ তাকে দিব্যি অনুসরণ করছে। পিরু আরও দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করল।