প্রকৃতির রঙে সেজেছে নিউইয়র্ক

মডেল: হুমায়রা নাজনীন আহমেদ (মৌরি)
মডেল: হুমায়রা নাজনীন আহমেদ (মৌরি)

আগামী ২১ জুন ক্যালেন্ডারের পাতা অনুযায়ী সামার বা গ্রীষ্মের প্রথম দিন। তার আগেই নিউইয়র্কের প্রকৃতি যেন রঙে, স্বরূপে, লাবণ্যে ফেটে পড়ছে। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। পথের মোড়ে মোড়ে তীব্র রঙা গোলাপ ফুলের গাছ। এখানে–সেখানে চলছে টিউলিপ উৎসব। চারদিকে যেন জীবনের মহাসমারোহ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, মাত্র কদিন আগেও এই প্রকৃতি পত্র-পুষ্পবিহীন শুষ্ক-শীর্ণ-দীর্ণ ছিল।
নিউইয়র্কের এবারকার আবহাওয়া সবাইকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছে। শীতপ্রধান দেশ বলে ১২ মাসের মধ্যে প্রায় ৮ মাসই ঠান্ডার দাপটে আমরা নিউইয়র্কবাসী নাজেহাল। সামারের শুরুতে শুরু হয়েছে উইয়ার্ড ওয়েদার। আকাশের মুখ বেজার করে বৃষ্টি হয়। আকাশের কান্না দেখলে আমারও কান্না পায়। ঝরঝর করে হালকা বৃষ্টি ঝরে। কখনো জানালা দিয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে চেরিফুল গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকি। সাদা সাদা জীবন্ত ফুল আসন পেতেছে প্রতিটি ডালে। সাদা ফুলের ফাঁকে কয়েকটা পাখির কিচিরমিচির দেখতে পাই। প্রকৃতি গাছপালা, ফুল–পাখির দিন আমরা মানবদের চেয়ে আগে শুরু হয়।
পাখিদের আমার কাছে বেশ কর্মঠ মনে হয়। কারণ পাখিদের কলতানে আমাদের ঘুম ভাঙে। স্রষ্টার বেঁধে দেওয়া নিয়মে ওদের কর্মযজ্ঞ চলে। প্রকৃতি হাসছে, নতুন করে আবার রূপ লাবণ্যে সাজছে। মানুষের মন ভালো করার জন্য কত অবদানই না রয়েছে এই প্রকৃতির। বিনিময়ে কিছুই চায় না। কিন্তু আমরা এমন অযোগ্য যে, প্রকৃতির মন ভালো করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আমাদের নেই। সৃষ্টিকর্তার কী অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম। তাঁর কোন অবদানকে অস্বীকার করা যায়? পারবে কেউ অস্বীকার করতে? পারবে না। যারা অস্বীকার করার তাঁবুর নিচে অবস্থান নিয়েছে, তাদের জন্মই অন্তঃসারশূন্য। শীতের সময় কয়েক মাসের জন্য সব গাছপালা ঠুন্ডা (পাতাহীন) হয়ে যায়। শীত যায়, বসন্ত উঁকি দেয়। নতুন পাতা নতুন ফুলের ফাল্গুনী আবেশ। এসবই হয় মহান সৃষ্টিকর্তার ইশারায়। শত শত বৈজ্ঞানিকে পৃথিবী ঠাসা। তারা কী তাদের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা দিয়ে ঠুন্ডা গাছে ফুল ফোটাতে পারে? পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যার কলসি নিয়ে কত সুজন বিজ্ঞানী পান মসলার হাসি হাসছেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্রিয়াকে অস্বীকার করা বিজ্ঞানীর সংখ্যা নগণ্য।

সামারের চারটি মাস সবার কাছে ভীষণ আকাঙ্ক্ষিত। দীর্ঘদিনের শীতের উপর্যুপরি অত্যাচারের পর মানুষের মুখে উজ্জ্বল হাসির দ্যুতি ছড়ায়। মানুষ শীতের মোটা কাপড় ক্লোজেটে ঢুকিয়ে রাখছে। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা উৎসব আমেজে রাস্তায় নেমে পড়েছে। পাশাপাশি নেমে পড়েছে সিনিয়র সিটিজেনরা। ভিড় জমেছে পার্কগুলোতে।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে মানুষ লীন হচ্ছে। চারদিকে শত কিসিমের ফুল, মনভোলানো ফুলের রং দেখে মন ভরে যায়। ফুল আর প্রকৃতির এমন চমৎকার মিলনের দৃশ্য দেখে উচ্ছ্বসিত মন ঘাসফড়িংয়ের মতো উড়ে। কখনো আকুলি-বিকুলি করে অতি সন্তর্পণে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমার ১৪ বছর বয়সী কন্যা সামার নিয়ে ফ্যামিলি প্ল্যান চূড়ান্ত করে ফেলেছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে তার হাইস্কুল শুরু হবে। সেই পর্যন্ত চলবে আনন্দ, উৎসব আর ঘোরাঘুরি। আমার দিকে হ্যান্ডনোট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শোনো মা, আমি প্ল্যান করে ফেলেছি। তুমি দুই/চার দিন ছুটি নেবে অফিস থেকে।’ আমি মজা করে বললাম, ‘ছুটি না নিলে হয় না?’ অমনি সে আমার গর্ভধারিণী মায়ের রূপ নিয়ে ফেলল, ‘মিলি আমি তোমার আম্মা বলছি, তোমাকে ছুটি নিতে হবে। তুমি গুড গার্লের মতো ছুটি নেবে।’
–‘ওহ আচ্ছা, আপনি কী আমার মা?’
–‘অফকোর্স আমি তোমার মা। নানুমনি গ্রেইভইয়ার্ডে শুয়ে আছে। তাই আমিই তোমার আম্মা। আমাকে এখন থেকে আম্মা ডাকবে।’
‘সব সময় আপনাকেই তো আম্মা ডাকি!’
–‘লাইফ টাইম আমাকে আম্মাই ডাকবে। নেহা ডাকবে না। হ্যাঁ এটা যেন মনে রাখতে পারো।’

মাঝে মাঝে নিজেকে কন্যার নিয়ন্ত্রণের মুখে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছা হয়, আম্মা যেভাবে বকাবকি করতেন, সেভাবেই মেয়েটা যেন বকাবকি করে বুকে কষ্টে চেপে হেসে যাওয়া তার এই কন্যাকে।
আমেরিকানরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। ছুটির দিন এলে তারা সেই সময়টার সর্বোচ্চ উপভোগ করে। সেই কারণেই ৭০/৮০ বছর বয়সী সিনিয়র সিটিজেনরা আমাদের দেশের মানুষের মতো ডিপ্রেশন–ফ্রাস্ট্রেশনে ভোগে না। তারা প্রতি মুহূর্তে আনন্দ খুঁজে ফেরে। জীবনের নেগেটিভ দিকগুলোকে তারা পজিটিভে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। আমি বহু বয়োবৃদ্ধ–বয়োবৃদ্ধাকে দেখেছি, কীভাবে দুর্দমনীয় তারুণ্য নিয়ে জীবনপথ পাড়ি দিচ্ছে। আমরা এশিয়ানরা অল্প কিছুতে ভেঙে পড়ি। আমেরিকানরা তার বিপরীত। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা জীবনকে স্বাভাবিক গতিতে টেনে নিয়ে চলেছে।
সামার মৌসুমে আমেরিকার সমুদ্রতীর, পার্ক, জাদুঘর, মুভি থিয়েটার লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। পরিবার নিয়ে সবাই ঘরে-বাইরে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করে। চারদিকে রঙিন পোশাক, রঙিন মানুষ। বাচ্চাদের আনন্দ চোখে পড়ার মতো। গ্রীষ্মের এই কয়টা মাস মানুষ হলিডে মুডে থাকে। যদিও সবাই কর্মজীবী। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে উপার্জন করে পরিবারকে সচ্ছলতা দিতে চেষ্টা করে।