জনক দিবসে অভিনন্দন তিনজন নারীর প্রতি

>এবারের বাবা দিবসে প্রত্যেকের মনে পড়বে জনকের কথা। তবে সদ্য বাবা হারানো তিতাস মাহমুদের একটু বেশিই মনে পড়বে। মমতাজউদদীন আহমদের মতো অসামান্য গুণী মানুষের সন্তান হতে পারা যে কারও জন্য অসীম গর্বের। একজন নামকরা শিক্ষক, লেখক, অভিনেতা, নাট্যকার—বহু পরিচয়ে অভিষিক্ত এই মানুষটি ছিলেন একজন কিংবদন্তি। বাবা দিবসের প্রাক্কালে বিশেষভাবে মনে পড়ছে টেলিভিশনের নাটকে ‘বাবা’র চরিত্রে মমতাজউদ্দীন আহমেদের হৃদয়স্পর্শী অভিনয়ের কথা। একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চরিত্রে, যখন তিনি বিয়ে না হওয়া শ্যামলা রঙের মেয়ের জন্য রং ফরসা করা ক্রিম নিয়ে আসেন, তখন অভিনয় আর বাস্তবের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না।

আসছে সপ্তাহেই ‘বাবা দিবস’। ১৬ জুন। আমার কাছে ওই দিনের নাম ‘বাবা দিবস’ খুব একটা পছন্দসই নয়। আমার মনে হয় ‘পিতা দিবস’ কিংবা ‘জনক দিবস’ কথাটিই বোধ হয় আরও ভালো শোনায়। সে যাই হোক, ‘জনক দিবসে’ সবাই পিতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়, তাঁদের অভিনন্দিত করে। সব বছর নানাজনের কাছ থেকে তেমন কৃতজ্ঞতা, স্বীকৃতি, অভিনন্দন আমি পেয়ে থাকি।
এ বছর জনক দিবসে আমি ভাবলাম, আমি আমাকেই অভিনন্দিত করব এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে কৃতজ্ঞতা ও স্বীকৃতি জানাব তিনজন নারীকে। এই যে আমি পিতৃত্বের আস্বাদন লাভ করেছি, পিতৃত্বের গর্বে গর্বিত হতে পেরেছি, পিতৃত্বের মতো একটি অবিস্মরণীয় একটি অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি, তার জন্য আমি নিশ্চয়ই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এর কিছুই তো হতো না, যদি না আমি দুজন অনিন্দ্য মানুষের পিতা না হতাম। তারাই তো আমাকে বাবা করেছে, তারা জন্মগ্রহণ করেছে বলেই না আমি পিতা হতে পেরেছি। সোজা কথায়, কন্যাদের কারণেই তো আমি এ বিরল সম্মান অর্জন করতে পেরেছি।
সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ ‘পিতা’ হিসেবে অভিষিক্ত হন, কিন্তু বৃহত্তর ও গভীরতর অর্থে সবাই পিতা হয়ে ওঠে না। পিতা হয়ে ওঠা সহজ নয়। আমার কন্যাদ্বয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে, তাদের কারণে আমি শুধু পিতা হইনি, তারা আমাকে পিতা হয়ে উঠতে জীবনের প্রতি পদে সাহায্য করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, প্রতিদিনই একটু একটু করে তারা আমাকে উন্নততর মানুষে রূপান্তরিত করেছে।

পিতা হিসেবে জীবনের বহু শিক্ষা তো তাদের কাছেই। তাদের প্রতিদিনের আদরে ভালোবাসায় মায়া-মমতার বহু কিছু তারা আমাকে শিখিয়েছে। আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করে তারা আমার পিতৃত্বকে একটি সৌহার্দ্যের ব্যঞ্জনা দিয়েছে। সন্তানের প্রতি সংবেদনশীলতা, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের শর্তহীনভাবে ভালোবাসার বহু শিক্ষা তাদের সঙ্গে নিত্যদিনের ব্যবহারেই তো শিখেছি।
বলা নিষ্প্রয়োজন, এ সবকিছুই আমাকে জীবনের বৃহত্তর অঙ্গনে অন্যদের সঙ্গেও একটা সুনন্দ অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করেছে।
নারী-পুরুষের সমতা, পরিবার ও সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানান করণীয় বিষয়াবলি তারাই আনাকে ওয়াকিবহাল করেছে। সমাজ বিজ্ঞানের নানান বিষয়ে পড়াশোনা ও পরবর্তী জীবনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ও অঙ্গনে কাজ করার জন্য এসব বিষয়ের নানান দিক সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সুপ্রোথিত। জীবনের নানান ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা, নারীর সম্মান, নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার বিষয়ে আমার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ার ব্যাপারে তারা নানাভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এখনো বহু বিষয়ে আমরা প্রায়ই বিতর্কে মাতি।
এ পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের মা পিতার ভূমিকায় আমাকে সহায়তা করেছেন প্রতিনিয়ত। কাজটি মোটেও সোজা ছিল না। আমাদের কন্যাদের ব্যাপারে তাদের মায়ের ভূমিকা ছিল শুধু প্রধানই নয়, বরং নন্দিত। আমাদের মেয়েরা তাদের মায়েরই সন্তান। তিনিই তাদের বড় করে তুলেছেন, তাদের মানুষ করেছে। সেখানে আমার ভূমিকা ছিল, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়—জোগালির। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমাদের কন্যাদের মাতা-পিতার ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমাকে পিতার স্থানটি শুধু ছেড়েই দেননি, সেখানে আমার কাজটি সহজ করে দিয়েছেন। তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতা অসীম।
এবারের ‘জনক দিবসে’ তাই আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমার দুই কন্যা ও তাদের প্রয়াত মায়ের প্রতি আমার পিতা হওয়া এবং আমার পিতা হয়ে ওঠার জন্য। নিজেকেও আমি অভিনন্দিত করি আমার পিতৃত্ব অর্জনের জন্য। সেই সঙ্গে অভিনন্দন চেনা-অচেনা সব পিতার প্রতি এই ‘জনক দিবসে’।
জানি, অনেকেই একটি বিশেষ দিনকে এর জন্য চিহ্নিত করতে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমি করি। যুক্তি আমার সামান্যই। বাতাসের মাঝে আমরা বাস করি বলে আমাদের প্রতিনিয়ত মনে হয় না, আমরা বায়ু সমুদ্রে নিমজ্জমান। সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ঝড় বা দমকা বাতাসের প্রয়োজন হয়। তেমনি প্রতিনিয়ত পাই বলে পিতৃ ভূমিকার কথা আমাদের সব সময়ে মনে থাকে না। সেট মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ‘জনক দিবস’-এর বড় প্রয়োজন।