আমার জীবনের প্রথম পুরুষ

কত সুখস্মৃতিই না আমার জীবনে মোহর হয়ে আছে। সবই স্পষ্ট, কপাট খোলা, আলোর মতো, অনন্তকালের প্রবহমানতায় বন্দী সেসব স্মৃতি-ছবি। আমার সুখের এই স্মৃতি-যাত্রাপথে, জীবনের সহস্র বাঁকের অজস্র অন্তরাল সরিয়ে, বিপুলভাবে যে মানুষটি আজ অবধি অবিরল উদ্ভাস রচনা করে, সে মানুষটি আমার বাবা।
অমন উচ্চকিত-জীবনস্নিগ্ধ মানুষ আমি আর দেখিনি। কতকাল আগে আমি তাকে হারিয়েছি, কিন্তু কী আশ্চর্য। আমি ফিরে ফিরেই অনুভব করি একটি আধুনিক মানুষের আনাগোনা, আমার মননে ও জীবনে, সব সময়ে। একজন মানুষ চলে গিয়েও কী করে বারবার ফিরে ফিরে আসে সংবেদে, বিস্ময়ে, দীপ্তিতে, বিষাদে, বিমূঢ়তায় আর অপার আনন্দে, তার আত্মজের ভুবন-দখল-খেলায় জয়ী হতে, আমি বুঝি না। কেবল জানি, আমার চোখের সামনের দেয়ালে তিনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন এই তাকিয়ে থাকাই তাঁর একমাত্র কাজ, যে কাজ তাঁর চিরদিনের, আর তাঁর এই চেয়ে থাকাতেই আমি পেয়ে যাই আমার জীবনের সব আনন্দবার্তা, আত্মবশ, আত্মস্পর্শ।
কতকাল আগের কথা। আমি তখনো স্কুলে যেতে শুরু করিনি, কিন্তু স্পষ্ট মনে পড়ে, একদিন আমার ছোট চাচা বাড়িতে ঢুকে চিৎকার করে, উত্তেজিত হয়ে ডাকছেন, কে আছিস, একটি জলচৌকি নিয়ে আয়, জিনিস এনেছি। আমরা মা, বড় খালা আর আমি বারান্দায় এসে দেখি, কাজের মেয়ে জলচৌকি এনে দিয়েছে ইতিমধ্যে, তার ওপর একটি বাক্স। চাচা অতি উৎসাহে বাক্স খুলে আমাদের সামনে জ্যোতির্ময় আঙিনা তৈরি করে, সারা বাড়ি তোলপাড় করতে রেকর্ড চাপালেন। আমি শুনলাম আর দেখলাম আমার জীবনের প্রথম চাক্ষুষ একটি বিস্ময়, কেউ গাইছে না, তবু গান হচ্ছে, পুরুষ কণ্ঠে। বাবা বেরিয়ে আসলেন ঘর থেকে, তাঁর চোখেমুখে সর্বাগ্র ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠছে খুশি, সেকি উৎসব আমাদের সেদিন, স্পষ্ট মনে পড়ে।
গ্রামোফোনে রেকর্ডটি অনেকবার বেজেছে। তারপর আরও কয়েক বছর পরে আমি তখন স্কুলগামী, রেডিওতে গান হচ্ছে, আমি বাবার ঘর পেরোচ্ছি। বিছানা থেকে ডাক শুনি, ভলিউমটা একটি বাড়িয়ে দে, শুনি, গান হচ্ছে—‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ’। শোনামাত্র আমার মনে পড়ে গেল, সেদিন গ্রামোফোনে এই গানটিই শুনেছিলাম। তারপর কত কত দিন, দুপুরে বিছানায় একলা একটু গড়িয়ে নিচ্ছেন, চোখ বুঁজে তিনি শুনছেন একই গান নজরুলের। গানটি অলংকারের মতো, আবর্তে আবর্তে তাঁর মানস করোটিতে বিহ্বল হয়ে উঠছে, কারও পায়ের শব্দ শুনে বলছেন, ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দে। আমরা বাড়িয়ে দিই। না তন্দ্রা, না নিদ্রা—আমরা জানি না। বাবা এই গানে গানে কোন এক আনন্দ-বেদনার জগতে বিলীন হতেন, আজও আমার বোধের অগম্য হয়ে আছে। অমন মানুষ আর কি হয়!
আমি তখন কলেজে পড়ি। লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে সীমাহীন বিশ্বাস, আগ্রহ ও পরিকল্পনায় অজস্র সময় অস্থির করে তুলছি। বাবা টের পেলেন। ভাবি, আঁতুড় ঘরেই আমার ‘সুন্দরম’ সবার অন্তরাল হবে। মন খারাপ নিয়ে অনিবার্য ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়ে রই। কয়েক দিন গেল, তারপর এক সকালে আমার কাঁধে হাত রেখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, লেখা জোগাড় হয়েছে? বলি, হ্যাঁ। পয়সা নেই? আমি চুপ।
লেখাগুলো দিস তো, পড়ব। আমি দিই। দুদিন পরে বললেন, ছাপার খরচ নিয়ে ভাবিস না, দেখি কি করতে পারি। আজ ভাবি, সেই ষাট–সত্তরের দশকে কলেজপড়ুয়া ছেলেকে তার বাবা সাহিত্যের সড়কে পা ফেলতে নিরাশ করেননি। আজ আমার চোখ এই স্মৃতি-চিত্রে ভিজে উঠছে। আমার বাঁচার পথটি আমার বাবা কী সংবেদনশীলভাবেই না সেদিন চিনে নিতে পেরেছিলেন। অমন মানুষ আর কি হয়!
ছোট বোনের চিঠি পাই একদিন, ১৯৮৩ সালের গরমে। লিখেছে, আমরা আসছি। আমরা মানে ‘আমি, বাবা আর মা’। আমি আর আমার স্ত্রী তখন বছর আটেক আগে এই দেশে এসেছি। মাত্র নতুন একটি বাড়ি হয়েছে। আগমন সংবাদটি পেয়ে সেকি আনন্দ আমাদের! সে এক সামার। সবাইকে নিয়ে উইকএন্ডে আশপাশে লম্বা ড্রাইভে যাই। শেষের দিকে নায়াগ্রা ফলসে গেলাম। আমরা একসময় জল-পতনের খুব কাছে যাই। অবাক বিস্ময়ে প্রকৃতির এই লীলা-প্রস্রবণ দেখি। কিছুক্ষণ পর আমরা গাড়ির দিকে ফিরে আসি, ফিরতে হবে। গাড়িতে ফিরে এসে দেখি, আমাদের সঙ্গে বাবা নেই। জলের কাছে গিয়ে আমি দেখি, বাবা তখনো অনড় চেয়ে আছেন জলপতনের দিকে। বিন্দু বিন্দু জল হাওয়ায়, জামা ভিজে যাচ্ছে বাবার, চুল উড়ছে, ভিজছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাকিনি, তাকে দেখছি, একরৈখিক দৃষ্টি ওঁর জলপতনের দিকে, বিরল সে দৃশ্য। জগতের সব বিস্ময় ম্লান হয় আমার বাবার বিস্ময়বোধের কাছে, অমন বন্দনা মুগ্ধতার, অমন অতল আস্বাদ জীবন-মহিমার, অমন শিশুর মতো সবকিছুকে উপেক্ষা একমাত্র জলপতন ছাড়া, আমি অবাক হয়ে চেয়ে রই। বেশ কিছুক্ষণ।
সেদিনের বাবার সেই অন্তর জগতের ঐশী বহিঃপ্রকাশে আমি আজও জীবনের জাগরণের ভূমিকায় জেগে উঠতে দেখি, সব ভাঁজে অখণ্ড বিস্ময়। অমন মানুষ আর হয়! সেবার দেশে ফিরে যাওয়ার সময়, উড়োজাহাজে ওঠার আগে, আমাকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, আর দেখা হবে কি না জানি না, ভালো থাকিস, দোয়া করিস। তারপর মাকে বোনকে নিয়ে খুব দ্রুত চোখের আড়াল হলেন।
বাবার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। দেশে ফিরে ছয় মাস পরে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি কি জানতেন, আমাদের আর দেখা হবে না?
হাসপাতালে আমার মাতামহের হাত ধরে বাবা বলেছিলেন, ‘আমার কোনো দুঃখ নেই, আমি জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ।’ ভাবি, মানুষ কখন পারে এ রকম বলতে? অমন মানুষ আর হয়! আমি প্রকৃতির প্রতিবেশে আহ্লাদিত হই রোজ রোজ। রোদ হয়, মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়, হাওয়া বয়, আকাশ ডাকে, ঝড় হয়, জানালার পাশে দাঁড়াই, দেখি আর শুনি, বাজছে, কিছু শব্দ হচ্ছে, অন্যরকম শব্দে বেজে বেজে উঠছে আমার আশপাশ, জলের প্রবাহে ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সব পথঘাট, সবকিছু পরে নিচ্ছে নতুন জামাকাপড়, শব্দে শব্দে নির্মিত হচ্ছে অর্কেস্ট্রা, দূর থেকে ভেসে আসছে, সেই গান, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ।’
হে পিতা, তুমি তোমার আত্মজকে অনেক কিছুই দিতে চেয়েছ, আমি গ্রহণ করিনি আমারই অক্ষমতায়। আমি জানি, তুমি বুকে ধারণ করে আছ অপরিমেয় প্রশান্তি, মগ্ন হয়ে আছ সুন্দরতার অনিবার্যতায়।