প্রস্থানেই ঘুচল একাকিত্ব

অনেক বৃষ্টির পর যেমন আকাশে দেখা দেয় রংধনু, কোলাহল মুখরিত হয় পাখির গুঞ্জনে পৃথিবীর চারধার, তেমনি আমাদের পরিবারে হাসি-আনন্দ-সুখ যেন সারাক্ষণ বিরাজমান। আমরা দুই ভাই-বোন, আর বাবা ও মা। বাবা চাকরি করেন; মা করেন বেবিসিটারের কাজ। মা ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না বলে ভালো কোনো কাজের জন্য চেষ্টা করেননি। অথচ মাইক্রো ইকোনমিকসে অনার্স করেছিলেন আমার মা। আমাদের পড়াশোনা মা-ই করাতেন। আমার নাম শ্যামা; আর ভাইয়ের নাম শুভ্র।
ভাইয়ার অটিজম রয়েছে। সে অস্পষ্টভাবে কথা বলে। তার জগৎটা যেন আমার থেকে ভিন্ন। তবুও বাবা-মা আমাদের কখনো বুঝতে দেননি যে, আমি সুস্থ বলেই ভালো সবকিছু আমার হবে।
মাঝে মাঝে পার্কে গেলে আমি খুব খেলতাম। আর ভাইয়া স্ট্রলারে বসে হাত পা ছুড়ত।একদিন সন্ধ্যায় মায়ের খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমার তখন বয়স চার-পাঁচ বছর হবে। বাবা অফিস থেকে এসেই মাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। ভাইয়াকে দেখাশোনার জন্য হোম অ্যাটেনডেন্স ছিল। আমিও বাসায় ছিলাম। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আমাদের এক প্রতিবেশী আন্টি আসেন। তিনি এলে হোম অ্যাটেনডেন্স চলে যায়। বাবা সকালে অনেক মানুষসহ এলেন। বুঝতে পারছিলাম না বাবাকে সবাই এত শান্তভাবে কেন কথা বলছিল। হঠাৎ ছল ছল চোখে আমাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
আমি অনেক কেঁদেছি। কিন্তু ভাইয়া বোঝেওনি তার জীবনে আজ থেকে মায়ের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। তখন থেকেই বাবা আমাদের খুব খেয়াল রাখতেন।
বাবাকে বিয়ের জন্য অনেক আত্মীয়, বাবার বন্ধু-প্রতিবেশীরা অনেক জোরাজুরি করেছেন। বাবা আমাদের জন্য আর বিয়ে করেননি। আমাদের ছোট সংসার ভালোই চলতে থাকল। বাবার খুব কষ্ট হতো যখন ভাইয়ার ডাক্তার থাকত। ভাইয়াকে রেডি করা যেন এক যুদ্ধের মতো মনে হতো। আমিও সাহায্য করতাম। আসলে আমি ভাইয়ার বড় বোনের মতোই ছিলাম। আমার সবকিছুই আমি বাবার সঙ্গে শেয়ার করতাম। বাবা আমাদের জন্মদিনে বাইরে পার্কে নিয়ে যেতেন। বাইরে খাওয়াতেন। সব সময় কেক নিয়ে বাসায় গিয়ে মায়ের ছবির কাছে আমাদের কেক কাটতে বলতেন।
কোনো কোনো রাতে আমি হঠাৎ জেগে দেখতাম বাবা বসে বসে আমাদের ছবির অ্যালবাম দেখছেন। বাবার এই একাকিত্ব বোঝার মতো বুদ্ধি তখনো আমার হয়নি। কখনো এমনও দেখেছি, অনেক রাতে বাবা খোলা জানালার কাছে বসে সিগারেট ধরিয়ে একটার পর একটা টেনেই যাচ্ছেন। বাবার মনে আর কোনো দুঃখ কি ছিল? বুঝিনি কখনো। স্কুলে আমি ভালো রেজাল্ট করলে বাবা গিফট দিতেন। সবাইকে ফোনে বলতেন। তখন আমি দশ-এগারো বছরের।
মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন হয়। তা আমার জীবনেও এল বোঝার আগেই। আমি স্কুল থেকে বাসায় এসেছি। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বের হয়েছি। এমন সময় বাবা খেতে ডাকলেন। আমি স্কুলের কাপড় বাথরুমে রেখে টেবিলে এলাম। ভাত খাব। তখন বাবা বাথরুমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বের হয়েই তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলেন। আমার খাওয়া শেষ হতেই আবার চলে এলেন। কিছুক্ষণ পর হাতে একটা ব্যাগ। কৌতুহলবশত আমি জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘তুমি এখন বড় হচ্ছ; এটা তোমার জন্য।’ ব্যাগের ভেতর কী আছে, যা আমার বড় হওয়ার সঙ্গে যুক্ত, তা বোঝার জন্য উঠতেই বাবা বললেন, ‘বাথরুমে নিয়ে যাও।’ ব্যাগটা খুলেই আমি হতবাক!
স্কুলের বন্ধুরা বলত, ‘তা বাবা কী করে বুঝল?’ আমার চোখে পানি এসে পড়ল। আমি সত্যই বড় হচ্ছি। এভাবে দিন গড়িয়ে গেল। আমি এখন কলেজে যাই। বুঝতে পারছি বাবা আমার জন্য ছেলে দেখতে শুরু করেছেন। আত্মীয়-স্বজনরাও চায় আমার বিয়ে হোক। বাবার পছন্দেই একদিন আমার বিয়ে হলো। সেদিন বাবা এক মুহূর্তের জন্য বসেননি। সারাক্ষণ সবদিকে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিয়ের দিন আমার বিদায়বেলা এল। বাবাকে দেখছিলাম না। পরে বাবাকে নিয়ে এল সবাই। আমি সালাম করতেই বাবা অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন, যেন মায়ের অভাবটা বাবা খুব বেশি অনুভব করছিলেন দিনটিতে। আমি বাবাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ি।
বাবার সংসার থেকে আমার প্রস্থানের পর বাবা ঘুমাতেন না। বাবাকে নিঃসঙ্গতা যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল। খুব বেশি ধূমপান করতেন। সবাইকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমার কি মনে হয় শ্যামা ভালো আছে?’
আমি প্রতিদিন দু-তিনবার করে ফোনে বাবা ও ভাইয়ের খোঁজ নিতাম। একদিন সকাল ভোরের দিকে প্রতিবেশীর ফোনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাবা আইসিইউতে ভর্তি। শুনে এক কাপড়ে বরসহ চলে এলাম হাসপাতালে। কেউ ঢুকতে দিল না। আমি শুধু আল্লাহকে ডাকছি। কিন্তু ভাগ্যলিপি তো আল্লাহ অনেক আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমার কানে শুধু একটা শব্দ ভেসে এল, ‘বাবা আর নেই।’ আমি লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে। এ আমার কল্পনার বাইরে। শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছি, ‘বাবা তুমি আমায় ছেড়ে যেতে পারো না! তুমি ফিরে এসো! ফিরে এসো তোমার শ্যামার কাছে!’
সে ডাক হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাবার নিথর শরীর চাদরে ঢাকা। ‘বাবা আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তোমার সাথে আর কথা হবে না দিন। তোমায় আর শাসন করব না সিগারেট খাওয়া নিয়ে। অভিমান আর কখনো করব না তোমার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে!’
ভাই আর আমি এখন ভালোই আছি। আমাদের জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। চলে যাওয়ার মাঝেই শেষ হলো বাবার একাকিত্ব। আর শুরু হলো আমাদের অন্য জীবন!