ওয়াহিদ জালালের একগুচ্ছ কবিতা

সৌন্দর্য-বিরহের অতীত সুর

সমস্ত ভালোবাসায় শুধু মায়া
যা আজকাল চুড়ির শব্দে ভেঙে যায়
তা হলো মানুষের পোড়া চোখের জল,
প্রণয়ের তীব্র প্রবণতা কোমল
বা পিরিতে কেমন বিষের জ্বালা
বেদনার সৌন্দর্যে অতি গভীরে ভাসমান।
সমস্ত আয়ুকাল ভেদ করে
একদিন জন্মের জরায়ু ছিঁড়ে এক চাষি
অবলার প্রাণে করেছিল জীবনের চাষ,
জীবনের গলুইয়ের ওপর বসে
কৈশোর রসে ভরপুর যেখানে পরান
মোহিনী আপনাকে সঁপে অতৃপ্ত বাসনায় ।
তবু ক্রমাগত ভাঙনের রেখা
ব্যথিত হয় নাই এমন অতীতকে স্পর্শ করে
প্রেমকামনার এক রসিক কালো কেশের মাঝে,
অজস্র কল্পনার ইন্দ্রধনু রচনা
করে যাচ্ছে বিরহের তুলসী পাতার ঘ্রাণ,
যেখানে এসে মাথা নত হয় তোমার নামে।

তোমাকে শনাক্ত করা যায়

তোমার পায়ের কাছে নুয়ে পড়ে
জীবনের চেয়েও অমর
মৃত্যু মগ্ন মিলনের হিংস্রতাহীন প্রার্থনা,
তবু মানুষের মন ক্ষুধার্ত হলে
নিজের নাকের কাছে বিনিদ্র রজনী
বসিয়ে রাখে প্রকৃতির মতো বাসনা।
মন কেঁদে ওঠে নদীর চিৎকারে,
মশা-মাছির ওজনের মতো
বুকের ভেতর জন্মের কল্পনায়
কোন অনন্ত সুখের সৌহার্দ্যে
তোমার তুমিময়ে আকারে বা নৈরাকারে
মরদেহের ক্লান্তি পিপাসা মিটায়।
এমন দৃঢ়তর করে তুলছে আমাকে
তোমার নাকফুলটিতে বসে থাকা
একবিন্দু ঘাস জোনাকির মতো,
যে সেলাইবিহীন কাফন একদিন
জীবনের জন্য আন্দাজ করেছি
আজ তোমার সম্মুখে আমাকে পাওয়ার
কামনায় সে চির ব্যর্থ ।

শূন্যতার পালঙ্কে আমার বিছানা

কুমারী বিষণ্নতার মাথায় হাত রেখে
আমি তার পথ আগলে রাখব বলে
যখন পথে নেমেছি,
তখন সে অনেক দূরের কাছে নিজেকে সমর্পণ
করেছে, আমি শূন্যতা-
শূন্যতা বলে যতই চিৎকার করেছি,
পাশের বনাঞ্চল উজাড় করে, ঝোপঝাড় ভেঙে
আমার প্রতিধ্বনির সঙ্গে ফিরে আসছিল
অবিরাম বনের বাসনা,
সে মুহূর্তে নিজেকে প্রাণপণ শুঁকতে লাগলাম
অরণ্যের চিরশুদ্ধ পঙ্‌ক্তি আর পালকের বাতাসে ।

হাহাকার করে মাঘের বাতাস

আবার কেন যে তাকাও আমার দিকে?
বলো, তোমার কি এত কাজ? আমি
সেই কবে থেকে আর ঘরে যাব না ভেবে
বিরান ভূমের সৌন্দর্যকে মায়ের চোখের
মতো ভেবে ডুবে আছি দুলে ওঠা
কুমড়োর মতো সেই বিলাপের ঐকতান ।

ভারাক্রান্ত বাঁশরির আলিঙ্গন আমাকে খুব
ব্যাকুল করে তুলছে অসুখের দীর্ঘশ্বাসে,
তোমার ওড়নার নিচেই সফেদ সমুদ্র বুকের
পাড় মেলে ডাকছে জোছনার চুম্বনকে সমস্ত রাত,
আমাকে ঘিরে কাঁদে একাকী রাত্রি, দিঘির
কালো জলের মতো অন্ধকার তখন রক্তজবার ঝোপে।
কুয়াশার খোঁপা খুলে দিল পিতার আর্দ্র দৃষ্টি
হাত পাতো, হাত পাতো বলে চিৎকার করে
ফেরেশতারা তাঁদের, আজ যাদের আলিঙ্গনে
চাঁদের মতো সুন্দর শাড়ি পরে ঢেকে রাখছে
জন্মান্তর, জন্মের চর, তবুও কৃষক মন ফসলের
গল্পেই আগ্রহী, তাই সাপের মতো মুখ ডুবায়
আদরের মাটিতে ।

সর্বনাশ বহন করছি

হৃদয়ের গভীরতম রহস্যলোকে
প্রত্যক্ষ প্রমাণের কথা মন্দনা,
তুমি ছাড়া কেউতো দেখেনি
তুমি ছাড়া সর্বত্যাগী সেই আয়না।
মৃত্যুস্রোতে ভাসমান জীবনের স্পর্শ
নবত্ব সৃষ্টির সঞ্চয়ে সৃষ্টির প্রয়াস,
কাহিনির গতি নিয়ন্ত্রিত করো
আদি-মধ্য-অন্তযুক্ত পিয়াস।
কেবলই তার লীলা তুলনায়
এমনকি দৃঢ় ছিল সৌন্দর্যে,
সজাগ আকর্ষণ ভাষায় বিদ্ধ
তীর্থদর্শন অসামান্যতা নিজের বিনয়ে।
যৌবন বেদনা গতিহীন এই জীবনভর
আকস্মিক সৌভাগ্য পরিতাপ পরানে,
আজও বুঝিতে পারি না আমি
নিবিড় স্পর্শ কেন পাষাণে?

আত্মকাব্য

বুকের গভীরে গর্ত নিয়ে
বাতাসকে আপন ভাবা যায় না
আজ আমার নিশ্বাস ভাঙল
জীবন নামের চিরসুখী আয়না।
মাটি পর্দায় ঢেকে রাখো
বিনয় তরঙ্গ তুলে কণ্ঠহীন,
সূর্যলোকে দেখা হবে না আর
বড় উদাস বুকের জমিন ।