তবু জীবন বহমান

আজকাল আমার বারান্দার কোনায় চেয়ারে বসেই দিন কেটে যায়। রাস্তা দিয়ে হরেক রকম ফেরিওয়ালা যায়, আমি ওদের দেখি। কোনো দিন দখিনা বাতাসে ওপরের ছাদের ফুল বা পাতা ছাদের কার্নিশ থেকে উল্টো দিকে ঘুরে আমার বারান্দায় এসে পড়ে। আমি কিছু মনে করি না। মানুষ কি জানে তার কোন কাজের ফল কোথায় গিয়ে ঠেকে? আট মাসে আমি এখন কখন কোন ফেরিওয়ালা আসবে, কবে কোন ফেরিওয়ালা আসল না, সব মুখস্থ হয়ে গেছে। চড়ুই পাখি দুটো ভেন্টিলেটরে বাসা বেঁধেছে। কিচিরমিচির, ঝগড়া, ভালোবাসাবাসি, দানা খুঁটে খাওয়া ক্লান্তিহীন দেখে যাচ্ছি। যে বাসে আমি রংপুর যাচ্ছিলাম, সেটি ছিল হানিফ পরিবহনের এসি বাস। ওই দিন আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। লিজা স্কুল থেকে ফিরে আসলে আমরা একসঙ্গে খেলাম। তখন আমার লিজাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল। লিজা আর আমি এক নিরবচ্ছিন্ন সুখের পুকুরে সাঁতার কাটছিলাম। তুমুল গর্জন করতে করতে বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাতের পর বৃষ্টি নামল। তখনই মনে হলো আজ আর যাব না।
রংপুর থেকে সেই সময় কলেজের অধ্যক্ষ ফোন করলেন। খুব জরুরি প্রয়োজনে যেতেই হবে। শেষ বিকেলের সোনা রং ঠেলে বৃষ্টি ধোয়া আকাশে এক মস্ত রংধনু উঠল, দেখতে দেখতে শ্যামলী বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে হানিফ কাউন্টার অফিসারের কাছে দুটো টিকিট চাইলে বলল—
-স্যার একদম শেষের আগের দুটো সিট শুধু আছে।
-কী আর করা। ওই বাসেই উঠে বসলাম। গাজীপুরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলাম যানজটের এলাকা চন্দ্রা। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পার হলাম যখন, তখন রাত। বিন্দু বিন্দু ফ্লোরেসেন্ট আলোকমালায় যমুনা সেতুর বাঁক দেখে ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা বিদেশের সেতুর কথা মনে পরে।
টিমটিম করে জ্বলা আলোগুলো দেখতে দেখতে একের পর এক স্টপেজ পার হই। গাড়িতে আমি সাধারণত ঘুমাই না। রাত একটা নাগাদ বগুড়ার ‘হাইওয়ে ভিলেজে’ থামল। আমি একটা নানরুটি আর খাসির ভুনা নিয়ে খেয়ে এক কাপ চা নিলাম। মালাই দেওয়া এই চা খুব ভালো হয়। ভূগোলের প্রফেসর এনামুল সাহেব কিছুই খেলেন না। তারপর গাড়ি সাঁ সাঁ করে ছুটল। রাতের রাস্তা ফাঁকা।
মাত্র তিন মাস আগে আমি ঢাকা শিক্ষা অফিস থেকে রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বদলি হই। লিজা আমার স্ত্রী। ও খিলগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক। আমাদের একমাত্র ছেলে নিলয় এ বছর নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছে। লিজা আর আমার নাকি দারুণ ম্যাচিং। আমি শিক্ষাভবনে সহকারী পরিচালক ছিলাম গত তিন বছর। আমার সঙ্গে এডি (কলেজ), ডিডি (কলেজ) সবার সখ্য। ডিজি ম্যাডামের স্নেহভাজন আমি আর লিজা। লিজা কিছুদিন আগেই দক্ষিণ কোরিয়া ঘুরে আসল কম্পিউটার ট্রেনিংয়ে। ও আর আমি সব পিকনিক, প্রোগ্রামে যাই। আমাদের বাসায় আমার মায়ের দেওয়া একজন বয়স্ক খালা আছেন, জরিনা খালা। যিনি আমাদের ছেলেকে বড় করেছেন। ১৮–১৯ বছর ধরে আছেন। আমাদের রান্না–বান্না করেন। আমাদের সংসার জীবন ছায়াছবির মতো।
হঠাৎ বিকট এক শব্দ আর ঝাঁকুনি। আমার পায়ের হাঁটু থেঁতলে সামনের সিটে ঢুকে গেল। সব জানালা বন্ধ। বাসের ভেতরটা ছিল কেমন আলো-আঁধারি। যাত্রী ঠাসা ছিল। আমার সামনে দুই বুড়ো, তাদের ঝিমুনি আর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। অনেক জোরে পেছনের বাস আমাদের বাসটাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছিল নাকি আমাদের বাসের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল কে জানে!
আশপাশের গ্রামের মানুষ এসে আমাদের উদ্ধার করে।
আর এখন আমার দেখাশোনার জন্য তেরো বছরের ছেলে বদিকে রাখা হয়েছে। বদি আমাকে বাথরুমে নিয়ে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। সকাল বেলা বিছানায় ব্রাশ পেস্ট আর ছোট বালতি নিয়ে আসে। আমি ব্রাশ করে বালতি টায় মুখ ধুয়ে ফেলি। সে ঘাড় থেকে তোয়ালে এগিয়ে দেয়। একটু পরে ট্রেতে করে নাশতা নিয়ে আসে। বিছানায় স্ট্যান্ড লাগানো টেবিল দিয়ে ট্রে ভর্তি নাশতা রাখে। আমার যা পছন্দ, যেদিন যা খেতে চাই, সেটাই খালা তৈরি করে। বদি আমাকে দিয়ে খেতে যায়।
আমি বলি
-বদি একটা মোড়া নিয়ে এসে এখানে বসে খা। গল্প করি।
-জি আচ্ছা।
-তুই কি দিয়ে খাচ্ছিস?
-আমি ভাত খাই। পান্তা ভাত।
-কেন? সাত সকালে ভাত কেন?
-স্যার ভাত খাইতে স্বাদ লাগে। অভাবে ভাত খাইতে পারি নাই অনেক দিন।
-লাল শাক, মুরগির ঝোল আর ডাইল যে মজা।
লিজা মনে করে সব স্বাভাবিক। এখনো আগের মতোই সব চলছে দেখাতে চায় লিজা। কিন্তু জীবন বদলেছে। আমার দুটো পা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা পড়েছে। আমি কেমন অস্বাভাবিক একটা জন্তু যেন। আমার নিজেরই আমাকে সহ্য হয় না। অসহ্য লাগে।
দুর্ঘটনার পর আমাদের উদ্ধার করে এই হাসপাতালে আনা হয়। এখন রাত অন্তত দুটা-আড়াইটা হবে। বিগত আট দিন যাবৎ আমি এই হাসপাতালে আছি। সেই দুর্ঘটনায় একজন সহকর্মীসহ আমি আহত হই। তিনজনের মধ্যে আমার আঘাতই গুরুতর। এই মুহূর্তে আমি বিপদমুক্ত। মানে জীবনে বেঁচে গেছি। কিন্তু দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এই গভীর রাতে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে আবছা অন্ধকার ওয়ার্ডে আমি রোগীদের দেখার চেষ্টা করছি।
এই ঘরখানা অন্তত পঞ্চাশ ফুট লম্বা। এই মুহূর্তে ঘরের দুই প্রান্তে দুটো বাল্ব জ্বলছে শুধু। দুই প্রান্তের আলোর নিচে দুজন নার্স তাদের টেবিল-চেয়ারে বসে। দক্ষিণ প্রান্তে যে বসে আছে, তার নাম মেরিনা। উত্তর প্রান্তের নার্স টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তার নাম শান্তা। মেরি একমনে একটা রেজিস্ট্রারের পাতা ওলটাচ্ছে। ভোরে মেরি আর শান্তা চলে যাবে, আসবে দীপা আর খাদিজা। এই হাসপাতালের নার্সগুলো একটু নরম স্বভাবের। খটমটে না। বেশির ভাগ রোগীই ঘুমে তলিয়ে আছে অথবা যাতে তারা ঘুমায়—ওষুধ দিয়ে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও চার/পাঁচজন রোগীর কাতর ‘আ.-উ.’ শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম।
আমি প্রবল বৃষ্টি খুব ভালোবাসি। বাইরের বৃষ্টির শব্দ ও মাঝেমধ্যে মেঘের গর্জন, বর্ষা পরিণত হয়ে নামলে যে শব্দে প্রচুর ধারাপাতের অঙ্গীকার থাকে, তেমনি গভীর গুমগুম শব্দ শুনলে অনেক মানুষের মতো আমারও দার্শনিক হতে ইচ্ছা হয়। তখন আদি–অন্ত, সাত-পাঁচ অনেক কথা ভাবতে থাকি আমি। পশ্চিমের জানালার বাইরে অন্ধকার চিরে বিদ্যুতের রেখা দেখা যাচ্ছে, কখনো-কখনো সেই আলোয় এক শ–সোয়া শ হাত দূরের পাচিল এবং পাচিলের ওপারে সুপারির উঁচু রোগা গাছগুলোর আন্দোলনও চোখে পড়ছে আমার। ঝিকমিক করে কখনো কখনো।
নার্সদের টেবিলের ওপরের আলোগুলো সিলিং থেকে লম্বা তার ঝুলিয়ে টেবিলের এক ফুট উচ্চতায় নামানো। ফলে মেরির আবছা মুখ ও আলোকিত বুক শুধু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। লিজার বুক এখনো এর চেয়ে দৃঢ়। মেরির যে অংশ এখন আলোকিত, সেই বুক খুব দৃঢ় না হলেও অবয়বে স্নিগ্ধ লাবণ্য আছে। সাদা শাড়ি সাদা ব্লাউজ আর মাথায় ক্যাপ পরা এই মেয়েটি খুব কর্তব্যপরায়ণ।
একটা হুইল চেয়ারে একজন মানুষকে বসিয়ে হাসপাতালের একজন কর্মচারী দরজা ঠেলে ভেতরে এল।
-সিস্টার, পেশেন্ট আছে।’
-আরও পেশেন্ট? কোথায় রাখব বল তো?’ মেরি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। একজন আয়াকে সে বলল,
-দুখানা কম্বল বের কর।
কম্বল আনলে মেরি সোজা আমার বেডের কাছে চলে এল। এই জায়গাটা ওয়ার্ডের প্রায় মাঝামাঝি। দুপাশের শয্যার মাঝখানে হাঁটা-চলার ফুট চারেক খোলা জায়গা। সেখানে একখানা কম্বল পেতে মেরি বলল,
-এখানে নামিয়ে দাও।— তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘একি, ঘুমাননি আপনি?’
বললাম–‘ঘুম আসছে না।’
-‘শুয়ে পড়ুন, শুয়ে পড়ুন। শুলেই ঘুম আসবে’—বলে নিজের টেবিলের দিকে চলে গেল সে।
বাহক দুজন লোকটিকে কষ্ট করে নামাল। দাঁতে দাঁত চাপা একটা যন্ত্রণার শব্দ করে সে কম্বলের ওপর বসল, তারপর নিম্নাঙ্গ ঘষতে পশ্চিম দিকের শয্যার একটা পায়ার সঙ্গে পিঠ ঠেস দিয়ে ‘আহ’ করে একটা কাতর শব্দ করল।
আবার সব চুপচাপ, শুধু বৃষ্টির শব্দ। পশ্চিমের দেয়ালের জানালাগুলো সব বন্ধ। কাচের ভেতর দিয়ে, অন্ধকার প্রকৃতিজুড়ে যে আলোড়ন, বিদ্যুতের আলোয় সে সব দেখতে পাচ্ছি আমি। দেখতে দেখতে নিজের তুচ্ছ অস্তিত্বের কথাও ভুলে গেলাম, এক সময় বসা অবস্থাতেই তন্দ্রামতো এসে গেল।
খুট করে খুব কাছেই একটু শব্দ হতে আমার আচ্ছন্নতা কেটে গেল। একটু পরে বিড়ির ধোঁয়ার উগ্রগন্ধ ছড়িয়ে পড়তে নিজের অস্তিত্ব আর অত তুচ্ছ মনে হলো না। তামাকের গন্ধ আমার বিগত আট দিনের বাধ্যতামূলক ধূমপান নিবৃত্ত ফুসফুসকে নিমেষে প্রলুব্ধ করে তুলল। অন্ধকারের মধ্যে নিচের লোকটি ওপাশের বেডের পায়ায় হেলান দিয়ে দুই হাতের আড়ালে বিড়ি লুকিয়ে ধূমপান করছে। লুকানো বিড়ির আগুনের আভায় তার বলিষ্ঠ সবল মুখখানি দেখে আমার আমার ফুসফুস ততক্ষণে অধৈর্য হাহাকার শুরু করেছে।
-‘বিড়ি আর আছে?’ আমি যথাসম্ভব নিচু হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
-‘খাইবেন?’ কোমরের গেজে থেকে বিড়ির কৌটো বার করল সে।
আমি বললাম
-‘দাদা দয়া করে ধরিয়ে তারপর দেবেন।’
লোকটি হাতের আড়াল করে লাইটার জ্বেলে বিড়ি ধরাল। হাত বাড়িয়ে জ্বলন্ত বিড়িটা নিয়ে নিয়ে দু-হাতের আড়ালে ধরে খুব দ্রুত টানতে লাগলাম আমি। আট দিন পর তামাকের ধোঁয়া আমার চোখে জল এনে দিল। কিন্তু ভেজা চোখেও আমি মেরির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলাম। যদিও আমার ব্র্যান্ড ফাইভ ফিফটি ফাইভ। বিড়ি শেষ হলে নিচের গামলায় ফেললাম আমি। বললাম,
-‘এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কোথা থেকে এলেন এত রাতে?’
লোকটি মুখ তুলে বলল,
-মোক কছেন, বাহে? অই হাট থিকা ফিরবার পথে টেরাকে ধাক্কা মাইরেছে হামার সাইকেলত। মনে কইরলাম মইরে গেছি, পরে দেখোসো ভগমানের কিরপায় এ যাত্রা বাইচ্চ্যে গেছি। তবে ডান পাওখানা বোধয় গেছে।’
পরে আরও বিস্তারিত শুনলাম, সে পাইকার হাটে–কিনে, হাটে-বেচে। কখনো কখনো দাদন করা মাল গ্রাম থেকে হাটে এনেও বিক্রি করে। বাজারের পাইকারেরা আবার তার মহাজন। কী জিনিস সে বিক্রি করে? সবজি, ধান, ডিম, মুরগি, হাঁস, খাসি, ছাগল, ফল ইত্যাদি যাবতীয় জিনিসেরই কারবারি সে। শহরের বাজারে যে সব জিনিসের কদর আছে, সবই সে কেনে এবং সবই সে বেচে।
বললাম, ‘এবার শুয়ে পড়ুন, আমিও শুই।’
লোকটি বলল—‘শুবো?’
-‘আমার শোয়া অ্যানা অসুবিধা আছে। শুবার পারোছো না। আপনে ঘুমান। আহ! ভগমান। কানাই কানাই।’
একটা সংক্ষিপ্ত কাতর শব্দ করে সে চুপ করে গেল। বাইরে হাওয়ার দাপট কমলেও এখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। সেই একটানা শব্দের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে হাসপাতালের স্বাভাবিক কোলাহলের মধ্যে আমার ঘুম ভাঙল। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। উঠে বসতে প্রথমেই পায়ের কাছে মেঝেতে বসা কাল রাতের সেই লোকটির দিকে আমার নজর পড়ল। পা বলতে আমার হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। ব্যান্ডেজে মোড়ানো। এখনো ব্যথা। তবে শক্তিশালী পেইনকিলার ইনজেকশন দেওয়ায় ব্যথা এখন সহনীয়। ব্যথায় ব্যথায় ব্যথা নাশ। ব্যথায় কাতর লোকটি তেমনি বসে আছে। কোমর থেকে ঊর্ধ্বাঙ্গ সে মাঝেমধ্যে এপাশ-ওপাশ করছে আর অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠছে। কাল রাতে নিশ্চয়ই তাকে কড়া ডোজের ব্যথা নিরোধক ইনজেকশন দিয়েছিল, এখন সে ইনজেকশনের প্রভাব স্তিমিত হয়ে গেছে।
পরশু দিন পর্যন্ত মাথায় মুখে ব্যান্ডেজসহ আমাকে জীবন্ত মমির মতো মনে হচ্ছিল। মুখ এখন ব্যান্ডেজমুক্ত, দু–একটা ক্ষত আছে। রাতের আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নাকি?’
চোখ খুলে লোকটি একটু ম্লান হাসল। তার সর্বাঙ্গে প্রকট যন্ত্রণা, তা সত্ত্বেও সে স্থির থাকার চেষ্টা করছিল। তার সহ্যশক্তি যে অন্য অনেকের চেয়ে বেশি, তাতে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। ব্যথা যে কী বস্তু, একদিনে আমি ভালোই জেনেছি। নয় দিন আগে দুর্ঘটনার মুহূর্তে জ্ঞানহারা হলেও যে মুহূর্তে জ্ঞান ফিরেছে আমি ব্যথা বেদনার পৃথক অনুভূতি না বুঝলেও, আমার যে ভীষণ রক্তপাত হচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলাম। আমার অর্ধাঙ্গিনী আর আমার ছেলে নিলয় আমার শয্যার দুপাশে বসা। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে নিয়ে যাওয়ার পথে আন্দাজে আমার স্ত্রীর হাত চেপে ধরে আমি শুধু বলতে পেরেছিলাম,
-খুলনার বাড়িতে কোনো খবর দিয়ো না।
তারপর থেকে সারাটা রাত আমি ক্রমাগত চেতন ও অচেতনের মধ্যে দুলতে দুলতে যেকোনো একদিকে পাকাপাকি ঢলে পড়ার প্রস্তুতি চালাতে থাকলাম। সাত দিন পরে খুলনায় আমার বোনের বিয়ে ছিল। লিজার মুখ আমার সামনে ঝাপসা হয়ে দুলছিল। আমার নিলয়
আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। লিজা কেমন পাথরের স্তম্ভিত মূর্তির মতো হয়ে গেল।
হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ড ব্যথার জগৎ, ব্যথা নিবৃত্তির জগৎও। ব্যথার উপলব্ধি, অভিব্যক্তি ও ব্যথাকে গ্রহণ করার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা একেকজন মানুষের একেক রকম। কাল রাতে আসা লোকটি যে ব্যথা সহ্য করার পরীক্ষায় প্রথম দিকে থাকবে, এ ব্যাপারটা আমি পরে বুঝেছিলাম। আমি নিজেও যে যথেষ্ট সহ্যশক্তির অধিকারী এ উপলব্ধিও এই দুর্ঘটনার শিকার না হলে আমার ধারণায় আসত না। হাসপাতালে এই নয় দিন অবস্থানে ব্যথার শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া কত রকম হতে পারে, তা বোঝার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে, ব্যথা ও ব্যথাহীনতার মধ্যে তৃতীয় আর একটি স্তর আছে। পছন্দ মতো শব্দ খুঁজে পেলাম না তাই নাম দেওয়া গেল না।
মেরি আমার সামনে এলে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কাল রাতে আমার পায়ের কাছে মেঝেতে যাকে ফেলে এলেন, তার কী হয়েছে? ‘
আটটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই। মেরি পরবর্তী বদলি নার্সের জন্য সব কাগজপত্র তৈরি করে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মেরি বলল,
–‘সার্জন না এলে কিছু করা যাবে না। পায়ের হাড়ে মাল্টিপল ফ্র্যাকচার। ফিবুলা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে ফিমার..’
ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তার সেন এলেন। আমাকে বসে থাকতে দেখে হেসে বললেন, –‘বাহ, আজ তো ভালোই আছেন দেখছি, গুড।’
তারপর নিচের লোকটির পায়ের কম্বল সরিয়ে দু-এক জায়গায় হাত দিতেই লোকটি একবারই জান্তব চিৎকার করে উঠল।
মেরির এখনো সময় পরিবর্তন আসেনি। ডাক্তার তার হাত থেকে ফাইল নিয়ে খসখস করে কিছু লিখে বলল, ‘এই ইনজেকশনটা এখুনি দিয়ে দিন। আর এক্স-রে রুমে পাঠিয়ে দিন একে।’
লোকটি যে বেডে হেলান দিয়েছিল, তাতে বছর দশেকের একটি ছেলে ছিল। তার পায়ে প্লাস্টার। ডাক্তার সেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ তোকে ছুটি দেব, মকসুদ।’ কুড়ি দিন পরে এসে প্লাস্টার কেটে যাবি।’ তারপর মেরির দিকে তাকিয়ে বললেন,-‘এই পেশেন্টের জন্য বেড খালি রাখবেন।’
নিয়ে যাওয়ার ছয় ঘণ্টা পরে অচেতন অবস্থায় ফেরত এল, এতক্ষণে যার নাম জেনেছি আমি, সেই অনিল। সে অবশ্য পুরোপুরি এল না, ডান পা খানা ওটিতেই রেখে এল। বিকেলের দেখা-সাক্ষাতের সময় একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে সতেরো-আঠারো বছরের একটি ছেলেও এল অনিলকে দেখতে। তখনো জ্ঞান আসেনি অনিলের। হাতের ইশারায় ছেলেটিকে কাছে ডেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাবা?’
সে বলল, ‘হ্যাঁ।’
গভীর রাতে গতকালের মতোই আবার প্রলয়ংকর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘুম ভেঙে গেল আমার। সেই অবিরল ধারাপাতের শব্দের মধ্যে অনিলের দুর্বল কণ্ঠস্বর আমার কানে এল। গোঁসাইয়ের কাছে সে জল চাইছে। আমি কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম তার কী রকম কষ্ট হচ্ছে। প্রথম রাতে আমারও ওই রকম অবস্থাই ছিল। আমারও তো কোনো অঙ্গহানির ঘটনা ছিল।
একটু পরে টের পেলাম, মেরি আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
-জল দেওয়া যাবে না আপনাকে। স্যালাইন যাচ্ছে তো, ওতেই কাজ হবে। এখন ঘুমান।
-ডাক্তার কি পাওখান কাটে বাদ দিছে, সিস্টার? ‘
-হ্যাঁ, সে তো আপনাকে বলাই হয়েছিল।
-না, তাই বলি। একটু জল দেবেন না, সিস্টার?
-না, জল খেলে বমি হবে। কষ্ট বেশি হবে।
-পাওখানায় যে বড়ো ব্যথা হচ্ছে, দিদি?
-ও তো একটু হবে। অপারেশন হয়েছে তো।
-না-না, তা কছি না। ও।
-ওঠিক হয়ে যাবে, ঘুমোন আপনি।
অনিল ‘আ আহ’ করতে থাকে।
-কেমন আছেন আজ? রাতে ঘুম হয়েছে? ডাক্তার জানতে চান
চোখমুখের চেহারা মুমূর্ষু, শুধু অভ্যাসবশতই ‘ভালো’ বলা।
অনিলের শিরায় স্যালাইন এখনো যাচ্ছে। হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে পা। আর সেই পা ব্যথা করছে অহর্নিশ। প্রথমে হাসি পেলেও আমার মনে পড়ল, এ রকম কথা আমি গল্পে পড়েছিলাম। যুদ্ধের হাসপাতালে কাটা পা চুলকাচ্ছিল আহত সৈনিকের। শেষ পর্যন্ত মর্গের ডাঁই করে রাখা মৃত মানুষ ও ব্যবছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতর থেকে নির্দিষ্ট পা খানা খুঁজে বের করে চুলকে দিলে সৈনিকটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অল্প বয়সে এই গল্প পড়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, যুদ্ধের আজগুবি গল্প একটা।
বিমলা অনিলের স্ত্রী। জ্বলজ্বলে সিঁদুর সিঁথি তার কপালে। আঁচলে নাক ঢেকে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। অঙ্গহারা হয়েও যে বেঁচে আছে স্বামী, এজন্য সে খুশি। সিঁদুর মুছতে হবে না, এ জন্য খুশি।
জায়গার নাম শুনেছি পীরগঞ্জ। আমি যাচ্ছিলাম হানিফ পরিবহনের বাসে। সিট পেয়েছিলাম একদম শেষ সারির সিটের আগেরটাতে। পেছনের চারজনই মারা যান। আমার আর আমার পাশের জনের পা কেটে বের করে গ্রামবাসী। রংপুর মেডিকেলে অপারেশন করে ব্যান্ডেজ করা হয়। সেই থেকে জীবনের হিসাবটা বদলে গেল। লিজা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ক্লাস জুনিয়র ছিল। আমি জানি না, লিজার ওপরে এর কী প্রভাব পড়েছে? লিজা আমাকে ইউনিভার্সিটির করিডরে ছুটতে দেখেছে। তাকে পেছন থেকে ঝুপ করে কোলে তুলে নিতে দেখেছে। আবার হাঁটুর নিচে কিছুটা এসেই টুপ করে পা শেষ হয়ে যেতে দেখছে। লিজার কেমন লাগে?
আমি ঠিক জানি না। মাঝে মধ্যে বোঝার চেষ্টা করি। লিজা এমন ভাব করে যেন কিছুই হয়নি, আমাদের জীবন বরাবর যেমন ছিল, তেমনই আছে। কিন্তু আমি জানি, এটা লিজার ভান। কখনো আমার খুব রাগ হয়। আর বেশির ভাগ হয় সন্দেহ জাগে। মনে হয়, সে অনেক কিছু লুকায়। যদিও আমি জানি, যাকে সন্দেহ করা হয় বিষয়টি তাকে মোটেও স্পর্শ করে না। যে করে সে-ই নিজেকে কুরে কুরে খায়। এসব ভাবনা থেকে বেরোতে চাইলে আমি বের হয়ে বাইরে গিয়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকি। বারান্দায় বসে থেকে টের পাই, লিজা ঘরে এসে ওর বই–ব্যাগ এগুলো রাখল। প্রথম প্রথম এক ছুটে আমার কাছে আসত। এসে বলত
-কি করলে? খেয়েছ ঠিকমতো?
-ভালো লাগে না খেতে।
-না খেলে শরীর খারাপ করবে যে।
-বুকের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। বড় প্লেটে খাবার নিয়ে মেখে মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। সারা দিন স্কুলে কী কী হলো সব বলে। আমিও দুপুরে দেখা বারান্দায় চড়ুই পাখির সেক্স নিয়ে বলি, ও হাসে। ওর মুখ কী একটু ম্লান হয়?
আজকাল আমি ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারি। কয়েকবার ডিজি অফিসে লিজা আর ড্রাইভার আমাকে নিয়ে গেল। খুব চেষ্টা করছি ঢাকায় একটা দায়িত্ব নিয়ে কাজে ফিরে যেতে। আমার এখন কিছুটা ভালো লাগে। এখন বদিকে ছাড়া আমি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতে পারি। বাথরুমে যেতে পারি। বারান্দায় বসে দেখি লিজা যায়। লিজা আসার সময়ও বসে থাকি। কদিন থেকে ওর আসতে অনেক দেরি হচ্ছে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজও বারান্দায় বসে ছিলাম। লিজা নামল সোহেলের গাড়ি থেকে। কেন? মনটা আষাঢ় মাসের মতো মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। লিজা ঘরে এসেছে বুঝতে পেরেও গুম হয়ে বসে রইলাম। লিজা আসল বারান্দায়। আমাকে বলল—
-তোমার জন্য সুখবর আছে। তুমি অফিসে ফিরে যাচ্ছ। এই যে অর্ডার। আমি তাও মন মরা হয়ে থাকি।
-কী, খুশি হওনি?
গত কয়েকটা মাস কীভাবে কী করল লিজা, তা ওই জানে। রংপুর থেকে ঢাকা চেতন–অচেতনের ঘোরে কীভাবে আসলাম। দোতলায় তোলা হলো। ওর স্কুলের পর ও ডিজি অফিসে ছোটাছুটি করে আমার কাজে ফেরার একটা ব্যবস্থা করতে। ডিজি অফিসের ভেতরের মানুষগুলো কেমন আমি জানি। সে জন্যই আমার জ্বলন হচ্ছে। কেন কী দরকার ছিল? পর মুহূর্তেই নিজেকে বোঝাই, না এভাবে দিনরাত বসে থেকে কী জীবন কাটবে?