বাবার মতো কেউ নেই

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিবস পালিত হয়ে থাকে। বাবা দিবসও তেমনি একটি দিবস। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়েছে দিনটিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রত্যেক বছর জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন হয়ে থাকে। আসলে বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার জন্য কোনো বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় না। তারপরও বিশেষভাবে এ দিনে বাবাদের প্রতি সম্মান জানানোর এই বিশেষ আয়োজন।
‘বাবা’ শব্দটা যেন এক বিশাল পৃথিবীর সমান। সব শ্রদ্ধা, দায়িত্ব আর ভালোবাসায় ঘেরা। একজন বাবা তার সন্তানদের শুধু ভালোবাসা নয়, তাঁর শেষ জীবনের নিশ্চয়তাটুকু উজাড় করে দিতেও দুবার চিন্তা করেন না। কারণ তার কাছে সন্তানের চেয়ে দামি আর কিছু নেই। বাবা তার সন্তানকে যে প্রতি মুহূর্তে ছায়ার মতো আগলে রাখতে চান। গ্রীষ্মের খরতাপে বটমূলের ছায়া যেভাবে শীতল করে সবাইকে, বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শত কষ্ট সহ্য করে তার সন্তানকে সেভাবে কঠিন বাস্তবতার কশাঘাত থেকে শীতল ছায়া দিয়ে থাকেন। সন্তানের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত বাবা যেন কখনই ভুল করেন না তার দায়িত্ব পালনে।
ভালো স্বামী না হলেও একজন ভালো বাবা হন। সন্তানের স্বাস্থ্য, বাসস্থান, লেখাপড়া—যাবতীয় গুরুদায়িত্ব পালন করতে বাবাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। সন্তান যখন তার আদর্শে চোখের সামনে বেড়ে ওঠে, পড়াশোনা শেষ করে গ্র্যাজুয়েট হয়, তখন বাবাদের আনন্দের শেষ থাকে না। বাবা মনে করেন তার সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুলাইন কবিতা মনে পড়ে গেল, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ বাবা যখন ছেলে থাকে, অনেক মন্দ কাজের সঙ্গে থাকলেও বাবা কখনই মন্দ কাজ করেন না। বাবা যে তার সন্তানের আদর্শ! বাবার আদর্শেই একজন সন্তান মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে বাবা তাঁর সন্তানের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য রোজগার করেন। সে ক্ষেত্রে জীবনের অনেক ঝুঁকি তিনি হাসিমুখে মেনে নেন। তাঁর কোনো অভিযোগ সন্তানের জন্য থাকে না। এত কষ্টের উপার্জন দিয়ে নিজে কোনো বিলাসিতা করেন না। তার নিজের সন্তানকে ভালো স্কুল, ভালো পরিবেশে রাখা— এটাই যেন বাবার আনন্দের অংশ! সন্তানের প্রশ্নে জীবনের শেষ সম্বলটুকু ছেড়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হন না। বাবার স্বপ্ন, তাঁর সন্তানকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দেখতে চান। একজন সন্তান তার ইগো। তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সন্তানদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে চান। আগলে রাখতে চান তাদের প্রিয় সন্তানটিকে। শীত, গ্রীষ্ম ক্ষুধায় নিজে কষ্ট করলেও সন্তানকে তিনি রাখতে চান পরম উষ্ণতায়। সন্তানের ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে চুরি করে হলেও সন্তানকে খাওয়াতে চেষ্টা করেন।
কিছুদিন আগে দেখা একটা ভিডিও ক্লিপের কথা মনে পড়ছে। একটা দুধ ফ্যাক্টরিতে একজন বাবা বাচ্চার দুধ চুরি করতে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের হাতে ধরা পড়ে। হট্টগোল শুনে পুলিশ কর্মকর্তা যখন জিজ্ঞেস করে, তখন ওই ব্যক্তি বলে চাকরি নেই, বাচ্চার ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সে এটি করেছে। পুলিশ অফিসারের মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত ছিল। সে তাকে বাবার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে ছেড়ে দিয়েছিল। দুধের দাম নিজে দিয়ে দিল। পুলিশ অফিসার একজন বাবা। তাই তিনি জানেন, আরেকজন বাবার দায়ভার তাঁর সন্তানের জন্য কতটুকু।
বাবা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমার নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল। এই বাবা দিবসে বাবার কিছু কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে। ছোট বেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। খেলতে গিয়ে দোতলার বারান্দা দিয়ে নিচে গোলাপ গাছের ওপর পড়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম। বাবা এই দৃশ্য দেখে জুতা ছাড়া খালি পায়ে দৌড়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। তারপর বাবার হাতে গোলাপ কাঁটা লেগে রক্ত ঝরছিল। ডা. ব্যস্ত হয়ে বাবাকে যখন চিকিৎসা দিতে চাইছিল, বাবা বললেন আগে আমার মেয়েকে সুস্থ্য করেন। পরে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন। এর নামই বাবা। নিজের ব্যথা, নিজের পায়ের জুতা সব যেন সেদিন ভুলে গিয়েছিলেন সন্তানের ব্যথার কাছে। মায়ের কাছে শুনেছি, আমরা পর পর পাঁচ বোন হয়েছি। বাবা আমাদের ছোট বেলায় যত্ন নিতেন। ঘুরতে নিয়ে যেতেন। বই পড়াতেন। আরও কত কিই না করতেন আমাদের জন্য। বড় হওয়ার পর আমরা মাকে কাজে সাহায্য না করলে মা মাঝেমধ্যে আমাদের বকা দিতেন। বাবা বলতেন ওদের বকাঝকা করো না। তুমি তো জান না, তোমার সন্তান বড় হয়ে কে কোনো ঘরে যাবে। যে কয় দিন বাবার বাড়ি ওদের একটু আনন্দ করতে দাও। বিয়ে হয়ে গেছে বড় হয়েছি, এখনো বাবার উৎকণ্ঠার শেষ নেই! প্রতি দিন ফোন করবেন। আমি ভুলে গেলেও বাবা ভোলেন না ফোন করতে! শুধু জানতে চান আমি ভালো আছি তো।
বিশেষ দিনে কিছু কেনার জন্য টাকা দিলে বাবা সেটা মসজিদের দান বাক্সে দিয়ে আমার জন্য দোয়া করেন। এমন আর কে হবে? এই যে বাবার ভালোবাসার উৎকণ্ঠা। এ যেন কখনই শেষ হওয়ার নয়। জীবনের কঠিন বাস্তবের মুখে যখন খেই হারিয়ে ফেলি, বাবা তুমি এভাবে আমাদের পাশে থেকো সারা জীবন। যে সংসারে বাবা নেই, বটবৃক্ষের ছায়াও যেন তাদের নেই। কারণ বাবাই তো আলোর মশালের মতো পথ চলার সঠিক পথ দেখান। বাবার মতো একজন অভিভাবক যে সংসারে নেই, সেই সংসারে যেন জন্ম নেয় শত অভিভাবক। তাই পৃথিবীর সব বাবার স্থান ঊর্ধ্বে। বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা সব বাবার প্রতি। যার হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শেখা। পরিবেশ বুঝতে শেখা। নিজেকে তৈরি করা। এই বাবা দিবসে সেই মহান বাবাদের প্রতি সম্মান, আর ভালোবাসা অটুট থাকুক সারা জীবন।