বয়স্কদের আশ্রয় বৃদ্ধাশ্রম?

সামাজিক দায়িত্ববোধকে আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। নিজের সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব যেমন বাবা–মায়ের, তেমনই তাঁরা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের দেখাশোনা বা আদর–যত্ন করার দায়িত্বও সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের চালচলনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে যেন অনীহা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এখন প্রায়ই দেখা যায়, ছোট সংসারের দোহাই দিয়ে তারা নিজ নিজ স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে পৃথক থাকতে শুরু করছে। যে সময় ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে একই সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে সময় কাটানোর কথা, তখন সন্তানদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে অসহায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
এ তো গেল সামাজিক দিক। সরকারের দিক দিয়েও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সহানুভূতি প্রদর্শন করা হচ্ছে না। উন্নত বা পশ্চিমা দেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যসেবা, পেনশনসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। আমাদের দেশে সে সব সুযোগ-সুবিধা যা পায়, তা সামান্য বলেই ধরে নেওয়া যায়। সে সব দেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ট্রেন, বাস, বিমানের টিকিটে মূল্য ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে, এমনকি বিদ্যুৎ, টেলিফোন, বাড়ি ভাড়া, বয়স্ক ভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলেও এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কিন্তু তা একেবারেই নগণ্য।
এদিকে আবার প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা বা সমীহবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। বাসে, ট্রেনে সব যানবাহনেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বসার পৃথক ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও সেগুলো অন্যান্য যাত্রী দখল করে বসে থাকে। প্রবীণদের দেখেও না দেখার ভান করে।
বর্তমান সরকারের আইন অনুযায়ী, ৬০ বছর বয়স হলেই চাকরিজীবীদের অবসর গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরম উন্নতির এই যুগে ৬০ বছর বয়সে মানুষ এখন বার্ধক্যের পর্যায়ে পৌঁছান না। তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই কর্মক্ষমতা, শারীরিক ও মানসিক বল অটুট থাকে। এ অবস্থায় তাদের চাকরি থেকে অবসর দেওয়ার ফলে তারা বেকারত্ব ও হতাশায় ভুগতে থাকেন।
আমাদের দেশে ইদানীং এক শ্রেণির সমাজহিতৈষী বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অবস্থা বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলছেন। উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে তাদের অনেকেই সামাজিকভাবে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী কষ্টে দিন যাপন করছেন। সংগতি ও সন্তানদের সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
যে সব ছেলেমেয়ে তাদের মা-বাবার প্রতি এ জাতীয় আচরণ করে থাকেন, তাদের মনে রাখা উচিত তাদেরও একদিন এভাবে বৃদ্ধাশ্রমে যেতেই হবে—যা তাদের জন্যও এক কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য।