সামার বুঝি এল

নিউইয়র্কে অবশেষে এল কাঙ্ক্ষিত সামার (গ্রীষ্ম)। সবখানে দেখি নানা পরিবর্তনের ছোঁয়া। এ যেন বিভূতি দাসের ‘স্তব্ধ দুপুরের কবিতা’।
কে বলে তুমি স্তব্ধ
কে বলে তুমি নিঃসঙ্গ।
এখানে কত ব্যস্ত তুমি,
ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত ছোটাছুটি
বড্ড ট্রাফিক জ্যাম।
কয়েক মাস ধরে নিউইয়র্কের সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কখন আসবে সামারের মজার সেই দিনগুলো। ঝকঝকে আকাশ। বাড়ির ভেতরসহ বাইরের দিনের অনেকটা সময় ধরে কড়া রোদের মাখামাখি।
চিলতে গার্ডেনে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন অভিযান। বাড়ির লাগোয়া বাগানে দেশি সবজি চাষের জোর প্রস্তুতি। ছুটি নিয়ে বসের সঙ্গে দেন দরবার। সবই কখনো নীরবে, কখনো সরবে। গত সপ্তাহে ছিল লম্বা হলিডে। ৩ জুন সোমবার মেমোরিয়াল ডে। সরকারি ছুটি থাকায় পুরো তিন দিনের ছুটি। সবার মধ্যে তাড়া ছিল। এমন দিনে শহরের মায়া ছেড়ে যেতে হবে সবুজের সন্ধানে। কেউবা গেলেন সমুদ্রের সঙ্গে মিতালি করতে।
এই সপ্তাহের প্রায় সব কটি দিন ছিল রৌদ্রস্নাত। সপ্তাহের শেষ দিনসহ প্রতিটি দিনই গ্রীষ্মের সঠিক চালচিত্র। বেলা বাড়লে সঙ্গে রোদ বেড়ে গেল বেশ। সঙ্গে চট করে চড়ে গেল সূর্যের তাপও। পাতাল রেলে চড়তে হলে নিচে নামতে হয়। সেখানেও গরমের হালকা ছোঁয়া। রাস্তায় বের হয়ে সামান্য হেঁটে চড়া রোদের তাপ একরকম জোর করেই বসিয়ে দিল রাস্তার পাশের একটি ঘন সবুজ গাছ তলায়। ভালোই লাগল গরমে গাছতলায় চুপচাপ একাকী বসে থাকা। তবে স্মৃতিতে ছিল, চৈত্রের গরমে বটগাছের তলায় চলত তাস পেটা, নয়তো দশ পঁচিশের নকশা করা কাপড়ের তৈরি বোর্ডে হইচই করে গুটি চালাচালি। বাসায় এসে পেলাম মেন্যু পরিবর্তনের তাগিদ। ফোনে বলা হলো, দেশ থেকে আসা ফ্রোজেন কাঁচা আমের প্যাকেট আনতে হবে। স্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আবহাওয়ার খবর নিয়েছি। ভালো গরম পড়বে। কাঁচা আম দিয়ে মাছের টক বানাব। জমবে ভালো। রুচির পরিবর্তন হবে। শুনে খুশি লাগল। সামার (গ্রীষ্ম) দেখি অন্দর মহলে ইতিমধ্যে জেঁকে বসে আছে।
ছয় ঋতুর সর্দার গ্রীষ্মের তেজ তো ক্রমে পরিমাপের বাইরে যাচ্ছে। সর্বত্র চলছে গ্রীষ্মকে বরণ করার নানা আয়োজন। কেউবা নিজেদের আপন পরিসরে, কেউবা বন্ধুদের নিয়ে করছেন চিত্তাকর্ষক পরিকল্পনা। এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পরিবার নিয়ে শহরের পাশে সাগরপাড় থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টি রেখেছেন বিশেষ অগ্রাধিকারে। এই গ্রীষ্মের অনেক আনন্দঘন আয়োজনের মধ্যে প্রতি বছর ভালো যে কটি আয়োজন হয়, তার মধ্যে নগরের বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য আন্তর্জাতিক বইমেলা একটি শ্রেষ্ঠ আয়োজন। বিগত ৭/৮ বছর খুবই কাছে থেকে দেখছি বলেই তা যে একটি ভালো আয়োজন, তা বলতে পারছি। দেশ-বিদেশের এত জ্ঞানী আর গুণীজনের একত্র বাস হয়, এখানে যে তাকে আর শুধু নিউইয়র্কবাসীদের মিলনমেলা বলা যাবে না। অলিখিত নিয়মে নিউইয়র্কের অনেক শুদ্ধচিত্ত আর ভালো রুচির কিছু মানব সন্তান গত ২৮টি বছর ধরে প্রতি বছর অপেক্ষায় থেকেছেন এই বইমেলার। যেখানে সদাই খুঁজে পান অনেক পরিশীলিত মনোহর ভাবনার খোরাক। আর সেই মেলা দরজায় কড়া নেড়ে বলছে, আমি এসে গেছি। তোমরা সবাই আসো চলতি সপ্তাহের শেষ দিনগুলোতে। অবসর সময়টুকুন কাটিয়ে যাও আমার সঙ্গে। আমি সে আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই ‘স্বাগতম স্বাগতম নিউইয়র্ক বইমেলা-২০১৯’।
নিউইয়র্কের প্রতি গ্রীষ্মে নানা পর্বের চমকিত নানা খোলস যখন খুলে যাবে তখন ক্রমাগত আসবে নানা আয়োজন আর আনন্দমাত্রা। তপ্ত প্রখর তাপ দাহে কেউ কেউ তৃষ্ণার্ত হবে বটে, আবার কেউ হবে উদাস। কবিতা আবৃত্তিসহ সুরেলা সংগীতের আয়োজন হবে। আয়োজন হবে কবিতা ও সাহিত্যপ্রেমীদের একত্রে একদণ্ড বসার। নিরন্তর আকাশপানে চোখ খুঁজবে আনন্দ। কোথাও জোরেশোরে চলবে প্রাণের কনসার্ট। সব ভাষায় সব জাতির মাঝে। সামারের সুন্দর এই সময়ে নেচে ওঠা এই শহরকে আমার ভালোবাসার এফ্রোদিতি রূপে দেখা বড্ড সহজ বলেই হয়তো আমি মন খুলে নগরের প্রতিটি নাগরিককে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিতে চাই ‘ভালোবাস আরও ভালোবাস। শুধু নিজেকে নয়, ভালোবাস তোমার সঙ্গে চলা লাখ কোটি সাদা–কালো–বাদামি–পিৎ বর্ণের সব নিউইয়র্কবাসীদেকে মন থেকে হৃদয় দিয়ে, অকৃপণ হয়ে। পরিশেষে কোন এক কবির ভাষায় বলি,
খালি চোখে যা দেখছ তার মাঝে
কিছুই দেখবার নেই।
তাই মনে মনে যা দেখবে
তাকে মনে মনে বল
আমি তোমায় ভালোবাসি।