মুক্তধারা বইমেলার স্মৃতি ও কিছু কথা

নিউইয়র্কে বাংলা ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বইমেলার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মুক্তধারা এই বইমেলার আয়োজন করে আসছে এবং এই পরবাসে বাংলা সাহিত্যের লালন-পালন, প্রসার ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
এ বছর চার দিনব্যাপী বইমেলার ২৮তম উৎসব শুরু হচ্ছে আজ শুক্রবার থেকে। চলবে ১৭ জুন পর্যন্ত। এ উপলক্ষে নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন তাদের শেষ মুহূর্তের আয়োজনে ব্যস্ত। আমন্ত্রিত অতিথিরা কে কবে এসে পৌঁছাবেন, কোথায় থাকবেন, কে কে তাদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাবেন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা চলছে অবিরাম। অন্যান্য সব বিষয়ও যাতে সঠিকভাবে সুসম্পন্ন হয়, যেন কোনো ত্রুটি না থাকে—এ জন্য আয়োজকেরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বইমেলা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯২ সালে। তারপর এতগুলো বছর কেমন করে যে পার হয়ে গেল, ভাবতেই অবাক লাগে। আমার পরম সৌভাগ্য যে, প্রথম মেলা থেকেই আমি এর সঙ্গী হতে পেরেছি। গত ২৮ বছরে কত শত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে এই বইমেলা ঘিরে, তা বলে শেষ করা যাবে না।
আমরা বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে পদার্পণ করি ১৯৮৯ সালে। প্রথম থেকেই আমরা নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি। এ ছাড়া এ দেশে আসার পর থেকেই আমার লেখালেখির জগতে অনুপ্রবেশ ঘটে। বাংলাদেশের বইমেলাকে মিস করলেও নিউইয়র্কের নতুন বইমেলাকে পেয়ে ভীষণভাবে আপ্লুত হয়েছিলাম।
ছোটবেলা থেকেই ছিলাম বইয়ের পোকা। বই পড়তে শুরু করলে খাওয়া দাওয়াও ভুলে যেতাম। এ জন্য অনেক বকাও খেতে হতো মাঝেমধ্যে। মা হয়তো ডাকছেন কোনো কারণে, কিন্তু সে কথা কানেই যাচ্ছে না, যেহেতু বইয়ের মধ্যে ডুবে আছি। ফিরে আসি আগের কথায়—সে সময় নিউইয়র্ক শহরে বাঙালির সংখ্যা ছিল সীমিত এবং অল্প কিছু লোক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িত ছিল। শুধু তাই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতে গোনা। যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অল্প কয়েকজন শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ও আবৃত্তিকার অংশ নিতেন। সে সময়ে বক্তার সংখ্যাও ছিল অত্যন্ত সীমিত।
যদি কবিতার কথায় আসি, তাহলে স্মৃতির পাতায় কিছু নাম ভেসে ওঠে, যারা প্রথম দিকের বইমেলায় কবিতা পড়তেন। সে সময় নিউইয়র্ক ও আশপাশের শহরে যারা ছিলেন, তাঁদের ভেতর স্বরচিত কবিতা পড়তেন সলিমুল্লাহ খান, ফরিদা মজিদ, সাকী সেলিমা, আলম খোরশেদ, ফরিদা বেগম, দীপ্তিময় রায়, হুমায়ুন কবীর শিহুক, আবু সাইদ শাহীন, হাসান আল আবদুল্লাহ, হাসান আহমেদ, ফারুক আজম, আমিনুর রশীদ পিন্টু প্রমুখ। এ ছাড়া ছড়া পড়তেন ফিরোজ আবদুল্লাহ। আরও কিছু লোক থাকলেও সবাইকে মনে করতে পারছি না। শ্যামা হাই, মিথুন আহমেদ, মাসুদুর রহমান, লিজি রহমান, মাহফুজা শীলু, রানু ফেরদৌসসহ কয়েকজন ছিলেন যারা কবিতা পাঠ করতেন। বিশেষ অতিথি ছাড়াও স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান বা সেমিনারে বক্তব্য রাখতেন মূলত জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সৈয়দ মোহাম্মদউল্লাহ, পূরবী বসু, সব্যসাচী ঘোষ দস্তিদার, হাসান ফেরদৌস, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ। এ ছাড়া সংগীত পরিবেশন করতেন সেলিমা আশরাফ, শহীদ হাসান, লাল ভাই, লাল ভাইয়ের ছেলে তানভীর সজীব, স্বপ্না কাওসার, নাইমা খান প্রমুখ। আমি যাদের নাম তুলে ধরলাম, তাঁদের সবাই প্রথম দিকের বইমেলায় অংশগ্রহণকারী, যাদের কথা আমার স্মরণে আছে।
প্রায় তিন দশকে বিভিন্ন রকম ভিসা লটারি প্রবর্তনের ফলে নিউইয়র্কে বাঙালির জনসংখ্যা বেড়ে এখন বিপুল। আর সংগঠন? এক কথায় অসংখ্য। এসব সংগঠন প্রতিনিয়তই নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছে। সারা বছর সাজসাজ রব ধরনের একটা ব্যাপার যেন লেগেই রয়েছে আজকাল। তবে সবই যে মানসম্মত অনুষ্ঠান হচ্ছে, তা হয়তো বলা যাবে না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং সবকিছুই যেন প্রচারসর্বস্ব হয়ে পড়েছে, মানের ব্যাপারটা গৌণ হয়ে পড়ছে। আধুনিক ইলেকট্রনিক মিডিয়া এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। এর মধ্যে ফেসবুক অন্যতম। মনে হয়, এসবের তাড়নায় যেন অধিকাংশ লোক সদা তৎপর এবং কিছু একটা করা চাই দ্রুত পরিচিতি লাভের আশায়। কিন্তু বইমেলা তার দীর্ঘ সাধনার দ্বারা একটা ব্যতিক্রমী অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
এখন নিউইয়র্কে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে পঞ্চাশ-ষাটজন কবিতা পড়ার জন্য চলে আসে। অধিকাংশই স্বরচিত কবিতা পড়ছে। তবে এখানেও মানের বিষয় নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বৈকি। তারপরও বইমেলা সবার জন্য উন্মুক্ত।
বইমেলার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বইমেলার আঙ্গিকও খানিকটা পাল্টেছে। মনে আছে, বইমেলায় শাড়ির দোকান দেওয়া শুরু হলে কী মন খারাপ হয়েছিল আমাদের অনেকের। মনে হয়েছিল বইমেলার বারোটা বাজল। তবে এখন দেখছি উল্টো কবি সাহিত্যিকেরা শাড়িও কেনে, বইও কেনে। আসলে যারা বই পড়তে ভালোবাসেন বা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কাছে এই মেলা একটি মিলন মেলায় পরিণত হয় প্রতি বছর। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আগত কবি-সাহিত্যিক, প্রকাশক ও শিল্পীদের আগমনে নিউইয়র্কের বইমেলা যেভাবে সেজে ওঠে, তাতে এখানে বসবাসরত বাঙালি সমাজেও একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়। উৎসাহ, উদ্দীপনা ও উদ্‌যাপনের মধ্যে বইমেলার কয়েকটি দিন পার হয়ে যায়।
এই বইমেলায় আমি এ পর্যন্ত নানাভাবে অংশগ্রহণ করেছি। কখনো কবিতা আবৃত্তি করেছি, কখনোবা কবিতার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি, কয়েক বছর সেমিনার আয়োজনের দায়িত্বে ছিলাম, কয়েক বছর আবার ছিলাম শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতার মূল দায়িত্বে। এ ছাড়া কয়েক বছর নিউইয়র্কের বাঙালি গুণী শিশু-কিশোরদের নিয়ে একটি নতুন প্রজন্মের বিশেষ অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছি। কিছু কিছু অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করেছি। কয়েক বছর ধরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ আয়োজন করে আসছি। এ ছাড়া স্বরচিত কবিতাও পড়ে থাকি। আসলে বইমেলার জন্য আমি সবকিছু করতে তৈরি থাকি, যা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের।
তবে, এই বইমেলা উপলক্ষে আমার যেটা সবচেয়ে ভালো লাগে, সেটা হলো বিখ্যাত সব লেখকদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া। আসলে একসময় যেসব লেখকের বই পড়ে আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়েছি, সেসব লেখকের সঙ্গে আমার সরাসরি আলাপ-পরিচয় হয়েছে এ বইমেলার আনুকূল্যে। এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! এ ছাড়া আমার একটা বাড়তি পাওনাও রয়েছে। বইমেলা শেষ হওয়ার পর আগত কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে একটা আড্ডা হয় আমার বাসায়। কোনো কোনো সময় অতিথি লেখক অথবা শিল্পীও আমার বাসায় থেকেছেন। ফলে অনেক কাছে থেকে এসব বড় মাপের মানুষগুলোকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে; তবে সেটা হয়েছে আমার স্বামী হাসান ফেরদৌসের কল্যাণে। অধিকাংশ লেখক, প্রকাশক তাঁর পরিচিত জন। ফলে বইমেলা শেষে একটা জম্পেশ আড্ডা হয়েই থাকে আমাদের বাসায়।
আসলে বইমেলার শুরু থেকে শেষ হওয়ার পরও কবি, সাহিত্যিক ও আয়োজকদের মিলন মেলা চলতেই থাকে; আনন্দের মহাসাগর যেন। এর শেষ হয় একে একে অতিথিদের বিমানবন্দরে বিদায় জানাবার মাধ্যমে। তারপর থেকেই শুরু হয় আগামী বছরের প্রতীক্ষা। এই বইমেলা ও আনন্দযজ্ঞ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ বিশ্বজিত সাহা ও তাঁর দলের সব দক্ষ কারিগরকে। বইমেলার চির জয় হোক।