জীবন যেখানে যেমন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বলছি মিউনিখে আসার প্রথম দিনগুলোর কথা। নভেম্বর মাস। কেমন রোদবিহীন মেঘাচ্ছন্ন দিনগুলো ছিল। ভাবতে বসলাম বোধ হয় শীতকালে সূর্য এ দেশে উঁকিই মারে না। ঘর থেকে ধূসর চাপা সাদা বড় বড় অট্টালিকাগুলো দেখে মনটা যেন আরও কুঁকড়ে উঠত এই ভেবে—কেন রঙিন না এই দেশটা, আমার দেশের মতো। কেন শীতকালে এখানে মিষ্টি রোদ ওঠে না। আস্তে আস্তে ভাবনার গভীরতায় নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিই, সামনের দিনগুলোতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব তো! কীভাবে কাটিয়ে দেব এই ভিন দেশে।

একেকটা বৃষ্টি মেঘলাময় ধূসর দিন যায় আর আমার মনে জমে থাকে চাপা কান্না যেন আর নীরব থাকতে অপারগ ছিল। কেননা এখানে তখন দিনের আলোর দেখা মেলে ৭টা অথবা তারও পরে এবং সন্ধ্যা নেমে আসে ৪টা ৩০ মিনিটের মধ্যে। নতুন মানুষ, তার সঙ্গে নতুন জীবন, নতুন দেশ, ভাষা, আবহাওয়া ও সময়ের এ পরিবর্তন—সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু ধাক্কা খাচ্ছিলাম যেন।

তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল—ভোর না হতেই অন্ধকার থাকা অবস্থায় একটু একটু আওয়াজ। তারপর শুরু হয় গাড়ি-সাইকেলের টুং টাং শব্দ। আলোর দেখা মিলুক আর না মিলুক, মানুষগুলো যেন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে নিজেকে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কী অন্ধকার, কী মেঘাচ্ছন্ন, কী বৃষ্টি, কী তুষারপাত যাই ঘটুক না কেন, মানুষগুলো যেন একেকজন সময়ানুবর্তিতার প্রতীক। আর তাঁদের সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা তথা ভালো চর্চাগুলোর জন্যই তো এঁরা ভালো জাতিতে পরিণত হয়েছে। এসব ভেবে যখন একটু আশার আলো পাই, তার পরক্ষণেই ভীত হয়ে যাই এই ভেবে, আমার দ্বারা সম্ভব হবে তো!

এই আলোর দেখা মিলল ঠিক দুই মাস ১১ দিন পর জানুয়ারি মাসে। ঝলমল এক রৌদ্র দীপ্তময় দিন ছিল সেদিন। সূর্যের এই স্ফটিক আলোয় ফিরে পেলাম যেন আমার প্রাণ। চলে গেলাম অবলীলায় বাড়ির পাশের পার্কটিতে। দেখলাম কিছু বৃদ্ধ তাঁদের নাতি-নাতনিদের নিয়ে লেকের হাঁসগুলোকে খাবার দিচ্ছেন। একদল বাচ্চা ছুটোছুটি করছে, পেছনে মায়েদের দল। কিছু মানুষ আবার আমার মতোই সবকিছু অবলোকন করছিলেন। মনে হচ্ছিল, আহা কী সুখ। শীতকালে রোদ পোহানো যাকে বলে। দীর্ঘ রোজা শেষে ঈদে যেমন সবাই আনন্দে মেতে উঠি, সেরকমই এক আনন্দ আমার মনে তখন শিহরিত হচ্ছিল। সব দেখে আমার নিরাশাবাদী মনটায় যেন একটু আশার আলো পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম তখন—এরাও তো দিব্যি সব পেরে যাচ্ছে, তবে কেন আমি নয়?

এর ঠিক পরের সপ্তাহ থেকে আমার ভাষার ক্লাস শুরু হয়। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনগুলো বাদে প্রতিদিনই ক্লাস। বলা যায় একধরনের একঘেয়ে জীবনে পদার্পণ। কারণ প্রতিদিনই একই সময় বের হওয়া ও বাসায় ফেরা হতো। আগেই বলেছিলাম, এঁরা তথা জার্মান জাতি সময়ের ব্যাপারে কখনই উদাসীন নয়। হয়তো তারই প্রতিফলন, কিছুদিন পর আমি হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম—কী বৃষ্টি, কী ঘন তুষারপাত, রাত কী ভোরে আমিও বের হচ্ছি। কই পেরে যাচ্ছি তো এখন! আসলে জীবন যেখানে যেমন। সময় তো কখনো থেমে থাকে না। তাহলে কেন এই জীবন? আসলে জীবনও কারও থেমে থাকে না, যদি চিন্তার মধ্যে পরিবর্তন আসে। থেমে থাকে শুধু স্মৃতিগুলো।

শাম্মী আকতার: মিউনিখ, জার্মানি।