ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবেন ট্রাম্প?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।

যুক্তরাষ্ট্রের মানববিহীন ড্রোন আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় ভূপাতিত করার শাস্তি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা সামরিক হামলার নির্দেশ দিয়েও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। হোয়াইট হাউসের সূত্র উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইরানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুদ্ধবিমান আকাশে ওঠার পর ট্রাম্প তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করেন কী কারণে, সে কথা এখনো জানা যায়নি।

ইরানের দাবি, ড্রোনটি তারা ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল দিয়ে আঘাত করে ভূপাতিত করে। ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল।

গত বছরের মে মাসে ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসে। এরপর থেকেই তেলসমৃদ্ধ এই দেশটির সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চুক্তিটি ত্রুটিপূর্ণ। ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, এই চুক্তিকে ব্যবহার করে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার ক্ষতিকর প্রভাব ও সন্ত্রাসীদের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েই চলেছে। নতুন চুক্তির লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়িয়ে চলেছে। এই চাপের কারণে দেশটির তেল রপ্তানি দৈনিক ২৫ লাখ ব্যারেল থেকে কমে মাত্র ২ লাখ ব্যারেলে এসে ঠেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র এই রপ্তানি শূন্য ব্যারেলে নামিয়ে আনার পক্ষে। অর্থনৈতিক চাপের পাশাপাশি সামরিক চাপ বাড়ানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটি যুদ্ধজাহাজ ও অতিরিক্ত সেনা পাঠিয়েছে।

বিশ্লেষকেরা এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে নিয়ে কী করতে চান। তিনি নতুন আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চান না, এ কথা নানা সময়ে বলেছেন। গত মঙ্গলবার ফ্লোরিডায় তাঁর পুনর্নির্বাচনী ক্যাম্পেইন শুরুর ঘোষণার সময়েও তিনি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন। বৃহস্পতিবার ড্রোন হামলার কথা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ইরান বড় ধরনের ভুল করেছে। পরে হোয়াইট হাউসে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সাংবাদিকদের জানান, এটি যে ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে, তা তিনি মনে করেন না। এটি হয়তো কোনো জেনারেলের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তাঁর সেই কথাকে অনেকেই এই মুহূর্তে নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু না করার ইচ্ছা বলেই ধরে নিয়েছেন। অবশ্য তার পরপরই জানা যায়, তিনি সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, যা অজ্ঞাত কারণে পরবর্তী সময়ে রদ করা হয়।

ট্রাম্প নিজে যুদ্ধবিরোধী হলেও পরামর্শদাতা হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই অবিলম্বে ইরানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক হামলার পক্ষে। তাঁদের অন্যতম হলেন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিটার বেইনার্ট মন্তব্য করেছেন, গত দুই দশক ধরে বোল্টন ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছেন। ‘তিনি বারবার যুক্ত দেখিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের লক্ষ্যে সে দেশের ওপর বোমা বর্ষণ করা উচিত।’

যুদ্ধের পক্ষে প্রবল উত্তেজক কথা বলা সত্ত্বেও ট্রাম্প এখন পর্যন্ত সামরিক হামলার পক্ষে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, যুদ্ধের কথা বলে তিনি নিজেকে একটি বৃত্তের ভেতর আটকে ফেলছেন। এখন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

শুধু ট্রাম্পের অতি-যুদ্ধবাদী উপদেষ্টারাই নন, ইরানের বিরুদ্ধে আশু সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিদার মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশও। সৌদি আরব ও ইসরায়েল উভয়েই মনে করে, ইরান তাদের জন্য বড় হুমকি। দুই দেশই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। গত মাসে একটি সৌদি তেলের ট্যাংকারে আক্রমণের জন্য ইরানকে দায়ী করে সৌদি দৈনিক আরব নিউজ অবিলম্বে ইরানের ওপর বোমা ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সিরিয়ার বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর ওপর সফলভাবে আঘাত হানে, ইরানের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে’, পত্রিকাটি পরামর্শ দেয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোন পথে এগোবেন, এখনো তা স্পষ্ট নয়। রিপাবলিকান নেতৃত্ব অবিলম্বে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে যুক্তি দেখালেও বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে ঐকমত্য অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন।

এ কথা কতটা সত্য, আগামী কয়েক দিনেই সব স্পষ্ট হবে। সবাই একমত, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে তার আগুন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এই যুদ্ধ ইরানের জন্য সর্বনাশা হবে, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। যে হরমুজ প্রণালি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ তেল রপ্তানি হয়, তা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা ইরানের রয়েছে। তেমন কোনো ব্যবস্থা নিলে সারা বিশ্বে তেলের দাম গগনচুম্বী হয়ে পড়বে। ছোট-বড় কোনো দেশই এর প্রভাব এড়াতে পারবে না।