আরও বিস্তৃত পরিসরে আয়োজনের আশা

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মননকে আরও বিকশিত করা ও বাংলাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দুই দিনব্যাপী ডিসি বইমেলা। বইমেলার আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষকেরা বইমেলাকে উত্তরোত্তর আরও সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
‘আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনের পেন্টাগন সিটি শেরাটন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ২২ জুন দুদিনব্যাপী ডিসি বইমেলার শুরু হয়। শেষদিন ২৩ জুন সমাপনই দিনে মেলা ছিল দর্শনার্থী আর অতিথিতে কানায় কানায় পূর্ণ। এতে এসেছিলেন অনেক গুণী লেখক, কবি, কণ্ঠশিল্পী, সাংবাদিক ও প্রকাশক। স্টলে স্টলে বই প্রদর্শনীর পাশাপাশি দুদিনই ছিল মনোমুগ্ধকর নানা আয়োজন। শেষ দিনে প্রথম দিন অনুষ্ঠিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

শেষ দিনে ‘আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো হয় ড. নুরুন নবী ও রোকেয়া হায়দারকে। নুরুন নবীকে সম্মাননা পদক তুলে দেন লেখক সেলিনা হোসেন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আনিসুল হক, রোকেয়া হায়দার, সামিনা আমিন, দস্তগীর জাহাঙ্গীর। নুরুন নবী তাঁর লেখালেখির পেছনের অনুপ্রেরণা এবং তার বিভিন্ন লেখনী সম্পর্কে কথা বলেন। তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন রোকেয়া হায়দার; তাঁর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন সেলিনা হোসেন। রোকেয়া হায়দারকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন আনিসুল হক। রোকেয়া হায়দার ও নুরুন নবী সম্পর্কে আনিসুল হক তাঁর অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। সেলিনা হোসেন এই সম্মাননা সম্পর্কে তার অনুভূতি প্রকাশ করে তাঁর বক্তব্যে মেলার আয়োজক, আগত অতিথিদের অভিনন্দন জানান। পরে অন্য এক অনুষ্ঠানে লেখক সেলিনা হোসেনকেও উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা দেওয়া হয়।

নানা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে দিনভরই ছিল বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান। কবি ও দূতাবাস কর্মকর্তা মাহবুব সালেহ, কবি সৈয়দ আল ফারুকের কবিতার বই নিয়ে আলোচনা হয়।
বইমেলায় স্টল নিয়ে উপস্থিত ছিল স্বদেশ শৈলী প্রকাশনী, প্রিতম প্রকাশ, নালন্দা, সময়, অনন্যা, আহমদিয়া মুসলিম জামাত, অঙ্কুর প্রকাশনী, পুঁথিনিলয়, মোস্তফা তানিম, ক্রিয়েট আ বিট, ঘুংঘুর, বিপিআই, আমরা বাঙালি প্রকাশনী। প্রথম দিনের মেলায় উপস্থিত কয়েকটি প্রকাশনী দ্বিতীয় দিনে চলে গেলেও নতুন আরও কিছু প্রকাশনী শেষ দিন মেলায় যোগ দেয়। মেলার প্রথম দিনে নিউইয়র্কের ‘ছড়াটে’-এর স্টল থাকলেও তারা চলে যাওয়ার পর সেখানে এসে যোগ দেয় বাংলাদেশ থেকে আসা অঙ্কুর প্রকাশনী।
মেলায় সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী নাহিদ নাজিয়াসহ অন্যান্য শিল্পী।

ডিসি বইমেলাকে উপলক্ষ করে মেলার দুই দিনই প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার স্টলে বসেছিল লেখক, কবি আর প্রকাশকদের মিলন মেলা। আড্ডায় জমায়েত হয়েছিলেন লেখক আনিসুল হক, খবর পাঠক রোকেয়া হায়দার, লেখক ও সংবাদ পাঠক আনিস আহমেদ, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী, শাহাব আহমেদ, লেখক নূরজাহান বোস, মোস্তফা তানিম, মৃদুল, সুবীর কাশ্মির পেরেরা, মোকাররম হোসেন, পলি শাহীনা ও সেলিনা আক্তার, কবি বেনজীর সিকদার, প্রকাশক ও লেখক হুমায়ূন কবীর ঢালী, পপি চৌধুরী, প্রকাশক জুয়েল রেদওয়ানুর ও মেসবাহউদ্দীন আহমেদ, লেখক ও সংগঠক সাইদুর রব এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী নাজিরউল্লাহ।

ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকা থেকে বইমেলা দেখতে এসেছিলেন কবি দেলওয়ার। তিনি জানালেন, মেলায় এসে তাঁর খুব ভালো লাগছে। মেলা নিয়ে কথা বলেন নিউইয়র্ক বইমেলার চেয়ারম্যান ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন ডিসি গত বছর থেকে বইমেলার আয়োজন শুরু করেছে। আয়োজকেরা বইমেলা সফল করতে আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। তাই আমি এখানে এসেছি। দেশ থেকে যে লেখক, শিল্পী, প্রকাশকেরা আসেন, আগেই পরিকল্পনা ঠিক করে নিলে তারা সহজেই ডিসি ও টরন্টো বইমেলায়ও অংশ নিতে পারেন। আশা করছি, এভাবেই অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের বাঙালিরাও বইমেলা আয়োজনে উৎসাহিত হবে।’

সংবাদপাঠক ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, তিনি এ বছরই প্রথম মেলায় এলেন। মেলায় এসে তাঁর খুব ভালো লাগছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই আয়োজনটি ধরে রেখে আরও সফল করা গেলে মেলা আরও বিস্তৃত পরিসরে করা যাবে।

‘আগুনমুখার মেয়ে’-এর লেখক নূরজাহান বোসও মেলা নিয়ে গঠনমূলক মনোভাব ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, গতবারের তুলনায় এবারের মেলা কিছুটা নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে। মেলায় গতবারের মতো শাড়ি, চুড়ি, প্রসাধনীর স্টল নেই। ফলে মেলা নারী দর্শকদের কাছে আবেদন হারিয়েছে। তিনি মনে করেন, সব মানুষই যে পাঠক হবেন, তা ভাবা ভুল। তবে বইয়ের পাঠক নয়, এমন নারীদের সঙ্গে আরও কিছু পাঠক অবশ্যই আসত। তাদের স্বামী বা শিশু সন্তানেরা সঙ্গে এলে তারা হয়তো বই নেড়েচেড়ে দেখত; বই দেখে হয়তো বইয়ের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হতো।
আমরা কথা বলেছি লেখক ও গবেষক হাসান মাহমুদের সঙ্গেও। বইমেলা নিয়ে তাঁর মত হচ্ছে, ‘মেলায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ আরও বিখ্যাত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদেরও বই আসে। সেখানে লেখকেরা যেন পাঠকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করে। মেলায় কবি, লেখক, নাট্যকার, সংগীত রচয়িতা, প্রকাশক ও গবেষক সবার সঙ্গেই পরিচয় পর্ব, আলোচনা হলে পাঠকদের সঙ্গে তাদের একটি সেতুবন্ধন তৈরি হয়। পাঠক ও দর্শকেরা প্রিয় লেখকদের সঙ্গে কথা বলার, তাদের দেখার ও জানার সুযোগ পায়। বইমেলা যে শেরাটনেই হতে হবে এমন কথা নেই। স্বল্প ব্যয়ে অন্য কোথাও হতে পারে।

হাসান বলেন, ‘মেলায় আমি এমন একটি কর্নার বা গোলটেবিল দেখতে চাই, যেখানে সবাই তাদের পুরোনো বই এনে রাখবে এবং সেখান থেকে যার যেই বইটি প্রয়োজন বা পছন্দ হবে, সে সেটা বিনা মূল্যে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে। বই বিনিময় কর্নারটি হয়তো একসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এবং কাজে লাগবে।’

লেখক ও স্থপতি আনোয়ার ইকবাল বলেন, ডিসি বইমেলা মাত্র দুই বছরেই উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি জনসমাজে একটা সাড়া জাগাতে পেরেছে। এ প্রয়াসকে আরও সামনে নিয়ে যেতে হবে।
দুদিনই বই প্রদর্শনীর পাশাপাশি বই নিয়ে আলোচনা, পরিচয়পর্ব, আবৃত্তি, নাটক, সংগীত, নৃত্য, সম্মাননা চলতে থাকে। আয়োজকেরা আগামী বছর আরও সুন্দর, সুসংগঠিতভাবে তাদের আয়োজন অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি দস্তগীর জাহাঙ্গীর মেলায় আসা প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও দর্শনার্থীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে বাংলা বই আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই সঙ্গে তিনি বইমেলা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন কমিটির সবাইকে মঞ্চে ডেকে ধন্যবাদ জানান।’