আমরা যদি সবাই এগিয়ে আসি

বিক্রমপুরের ভাগ্যকূল গ্রামে বিনে পয়সায় বই পড়ার ব্যবস্থা আছে
বিক্রমপুরের ভাগ্যকূল গ্রামে বিনে পয়সায় বই পড়ার ব্যবস্থা আছে

‘পাখি তাদের খাবার জোগাড় করতে ব্যস্ত। তাদের খাদ্য কোথাও নির্দিষ্ট করে রাখা থাকে না, কিন্তু তারা জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে চলে। তেলাপোকাও ব্যস্ত, অথবা তারা রাতে ব্যস্ত ছিল এবং দিনের বেলা বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্বের সব প্রাণীই তাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। এই যে আপনি এখানে বসে আছেন এবং চিন্তা করছেন, জীবনের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে-এই সমস্যা আপনি কোথায় পেলেন? আপনি এই রকম ভাবছেন বা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন; কারণ, একটি নির্দিষ্ট স্তরের বুদ্ধি আপনাকে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই গ্রহের জন্যও আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে; তাই আপনি ভাবছেন।’

ওপরের বক্তব্যগুলো সাধগুরুর। খুব সত্য কথা। আমরা প্রাণী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আমাদের কিছু না কিছু করা প্রয়োজন। এটা যদি সবাই ভাবতাম, তাহলে হয়তো অনেক কিছু করতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানুষ হলেও আমরা সবাই এমন করে ভাবতে পারি না, বা ভাবলেও কিছু করি না। তবে অনেকেই এমন ভাবেন এবং কিছু একটা করেন। এ রকম কিছু মানুষের কথা যখন জানলাম, মনে হলো ব্যাপারটা সামনে আনা উচিত। আজ তাঁদের কাজের কথা, পরিকল্পনা এসব নিয়ে বলব। তাঁরা দীর্ঘ দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছেন—গ্রামের মানুষকে শতভাগ শিক্ষিত করে তুলবেন। তাঁদের পরিকল্পনায় আছে দশ বছরে গ্রাম থেকে অন্তত দশ জন মানুষ বের করা, যারা জীবনে আলোকিত হবেন এবং দেশকে কোনো না কোনোভাবে সমৃদ্ধ করবেন। তাঁদেরই একজন মোহাম্মদ আলিম।

আমার এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলিম বলেছেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের সবাই পড়াশোনা করবে, বিজ্ঞানমনস্ক হবে, তাদের মধ্যে কোনো ধর্মান্ধতা থাকবে না, তারা মানবিক হবে। একটা পরিবারে যখন শুধুমাত্র একজন মানুষ শিক্ষিত হয়, তখন তাকে বোঝার মতো কেউ থাকে না। অতি আদরে তাঁকে মাথায় তুলে রাখলেও প্রকৃত অর্থে তাঁরা এক ধরনের কষ্টে থাকেন। কারণ, তাঁরা যা বলতে চান বা বোঝাতে চান, তা বোঝানো যায় না। এ জন্য উচিত পরিবারের সবাইকে শিক্ষিত করে তোলা। একটা গ্রামের সবাই যখন শিক্ষিত থাকবে, তখন তাদের জ্ঞান বিনিময়টা হবে যথাযথ। এ হার্মোনির অভাবে জ্ঞানী মানুষও সব সময় এক ধরনের শূন্যতায় ভোগেন। ভেবে দেখুন, কত সুন্দর বিষয়টা; আশপাশে সবাই শিক্ষিত!’

গ্রামের নাম ভাগ্যকূল। এটা বিক্রমপুর জেলার একটা গ্রাম। সেই গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি একটা লাইব্রেরি করেছেন এবং সেখানে বিনে পয়সায় বই পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। গ্রামের কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বড়পা সবাই বই পড়বেন এবং এটা স্কুল-সংক্রান্ত নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা পাবলিক লাইব্রেরির মতো করেছেন তাঁরা। লাইব্রেরির নাম ‘ভাগ্যকূল পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’। স্থানীয় স্কুলের সামনে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন তাঁরা। প্রাথমিক অবস্থায় উদ্যোক্তারা মিলে আর্থিক ব্যবস্থা করেন। কিন্তু পরে গ্রামের অনেকেই স্বেচ্ছায় সেখানে দান করছেন। একটা তহবিল তৈরি করা হচ্ছে সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে। এর প্রধান উদ্যোক্তা হচ্ছেন, মুজিব রহমান, মৃত্যুঞ্জয় বর্মণ, আব্দুর রহমান, সুদীপ্ত সাহা বাঁধন, নাসির খান, মোহাম্মদ জুবায়ের, মোহাম্মদ আরিফ শিকদার, মোহাম্মদ মাসুদ ও মোহাম্মদ আলিম। এ ছাড়া শান্ত, তুষার, ফারুক আহমেদের মতো আরও অনেক সদস্য রয়েছেন। মেয়েরা সদস্য হিসেবে নেই; তবে তারা বই নিচ্ছেন নিয়মিত।
লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনাও করা হয় এবং মানুষকে বই দেওয়া হয় পড়ার জন্য; পড়া শেষে তারা আবার তা ফেরত দিয়ে যায়। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন একটা আলোচনা সভা হয়। সেখানে উপস্থিত সবাই তাঁদের পঠিত বই থেকে নিজের মতামত প্রকাশ করেন। মানুষকে উৎসাহিত করতে তাঁরা সম্পূর্ণ বিনে পয়সায় এ সেবা দিচ্ছেন। কেউ বই ফেরত না দিলে তাঁকে ফোনে অনুরোধ করা হয় যেন তিনি বই ফেরত দেন। লাইব্রেরিতে ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’, উইলবার স্মিথের ‘রিভার গড’, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ ও ‘মহাকাব্য এবং মৌলবাদ’, সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’, ‘সাতকাহন’, হ‌ুমায়ূন আজাদের ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘নারী’সহ দেশি-বিদেশি লেখকদের নানা বই রয়েছে।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাইব্রেরি স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণের পর তা বাস্তবায়নের জন্য তাঁরা খুব বেশি সময় নেননি। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা তাঁদের কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতেই পাঠাগারটি চালু করেন।

তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে এলাকাকে অগ্রসর করা এবং মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা। ছেলেমেয়ে সবার জন্য গল্পের বইগুলোর চরিত্র হচ্ছে সবচেয়ে বড় উৎসাহদাতা। যখন একটা বই পড়তে পড়তে কোনো চরিত্রে একটা কিশোর বা কিশোরী নিজেকে কল্পনা করে, তখন তারা নিজেকে তৈরি করতে শুরু করে। এ প্রেরণা আসে একমাত্র বই থেকে। বই যেমন মানবিক হতে শেখায়, তেমন শেখায় প্রতিবাদী হতে, সাহসী হতে। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করে বই।

সমাজের ঘুণে ধরা অবস্থার পরিবর্তন করতে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা বলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, পরীক্ষা পাশের জন্য কিছু বই পড়া নয়। সর্বস্তরের জ্ঞান অর্জনই লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ লক্ষ্য যদি প্রতিটি গ্রাম ও পাড়ার মানুষ গ্রহণ করতেন, তবে হয়তো আমাদের আজ এত অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হতো না। অনেকের বাড়ি শূন্য পড়ে আছে, টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে; কিন্তু তাঁরা এমনটা ভাবেনও না। যদি সবাই ভাবতেন যে, নিজের এলাকাকে শিক্ষায় সমৃদ্ধ করি, তবে অনেক কিছু হয়ে যেত। ভাগ্যকূল গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি ও যুবকের এ কাজ সবার সামনে নিয়ে আসার একটাই উদ্দেশ্য—মানুষ হিসেবে আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে ভাবতে পারি। ভাবতে পারি, এ সমাজ পরিবর্তনের কিছু দায় আমাদের নিতে হবে। শুধু নিজের খাওয়া-পরার চিন্তা করতে থাকলে, পাখি আর তেলাপোকার থেকে আমরা আলাদা হতে পারব না। একদিন ভাগ্যকূল গ্রামের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হবে সারা বাংলাদেশ। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে, যদি আমরা সবাই এগিয়ে আসি।