পেয়িং গেস্ট

ভারতবর্ষ। অনেক ভাষাভাষীর বিরাট দেশ। বিচিত্র এ দেশের মানুষের কথার বুলি। বৈচিত্র্যপূর্ণ সে দেশের মানুষের পোশাক। খাদ্যাভ্যাসে তেমনি অনেক, বিভিন্ন চেহারা। আবহাওয়ার তারতম্যও কম নয়। এ সবই সবার কম-বেশি জানা। পাশাপাশি ধর্মীয় আচার-আচরণে রয়েছে নানা মত আর নানা পথ। প্রথমবার ভারত সফরে দিল্লির লাল কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, ওই খানে দাঁড়িয়ে রইলে পুরো ভারতের না হলেও ভারতের বিরাট অংশের জনমানবের আংশিক পরিচিতি পাওয়া যাবে। তা পাওয়া গেলও বেশ ভালো পরিমাণের। প্রতি মিনিটে চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নানা উচ্চতার, নানা বর্ণের ভারতীয়রা। মুখের ভাষায়, স্বরে কতই না ব্যবধান। তবে ভালো করে লক্ষ্য করে একটি বিষয় মনে ধরল। সবারই মধ্যে নানা আকার আয়তন অথবা রং-ঢঙে পরিবর্তন আছে।

তবে পরিবর্তনশীল নয় দেশপ্রেম। আপন দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও সর্বোচ্চ রক্ষণশীলতা অবাক করার মত। জিজ্ঞাসা হতে পারে, খানিক সময় দাঁড়িয়েই কীভাবে ভারতবাসীর দেশপ্রেম বোঝা গেল! দেখলাম অধিকাংশ ভারতীয়দের পোশাক বা ব্যবহৃত শৌখিন দ্রব্যে বিদেশি পণ্যের ছাপ অপেক্ষাকৃত কম। তা কিন্তু বেশির ভাগ পথচারীদের ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেই বলছি। আমরা দুই বন্ধু প্রথমবারের মত ভারতে গেলাম ১৯৯১ সালে। ঢাকা থেকে বিমানে গেলাম পার্শ্ববর্তী শহর কলকাতার দমদম এয়ারপোর্ট। ট্যাক্সি নিয়ে শহরে যাওয়ার পর যথারীতি এক পরিচিত ব্যক্তির আশ্রয়ে ছিল আমাদের চলাফেরাসহ থাকা খাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা। সেই পরিচিত আত্মীয় চাকরি করতেন কলকাতার নামকরা হাসপাতাল শিশু মঙ্গল হাসপাতালের টেলিফোন অপারেটর পদে।

হাসপাতালের এক্সচেঞ্জের নম্বরে ফোন করলেই তিনি ফোন ধরতেন। শুধু জানাতে হতো, আমরা কলকাতায় বেড়াতে এসেছি এবং কত দিন থাকব। অথবা বাইরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, তাও সেই আত্মীয়কে জানিয়ে দিতে হতো অকপটে। সব শুনে ঠাট্টা করে বলতেন, হুম বুঝেছি। সুনামগঞ্জের হাওরে এবার বুঝি বোরো ফসল ভালো হয়েছে! যতক্ষণ না ওই ধানগুলো খরচ হচ্ছে, ততক্ষণ তোমাদের জানে আর শান্তি নেই। তোমাদের আমি চিনি না মনে করো! বলেই সোজা হুকুম, চলে যাও রাসবিহারী অ্যাভিনিউর সেই হোটেলে। যেটির মালিক ছিলেন ওনার পরিচিত এবং বাংলাদেশ থেকে আগত খুলনার লোক। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের একজন বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান। পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলিম ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পত্তি বদল করে কলকাতায় থিতু হয়েছেন ৭৫ বছর আগে। রদবদল করে বানানো বাড়িতে থাকা-খাওয়া দুটোরই ব্যবস্থা ছিল খুবই ভালো। বললেন, যাও হোটেলে গিয়ে আজকের মত বিশ্রাম নাও। রাতে ডিউটি শেষ করে আসছি। তখন বাকি সব ব্যবস্থা হবে। চিন্তার কোনো কারণ নাই। রাতে সময়মতো এলেন। সঙ্গে প্যাকেটভর্তি শুকনো মিষ্টি। জিজ্ঞেস করলেন, শুধু কলকাতায় থাকবে না বাইরে কোথাও যাবে? উত্তরে বললাম, এবার বাইরে দু-একটি শহরে বেড়াতে যাওয়ার বড্ড ইচ্ছে। উত্তরে চট করে বলে দিলেন, অসুবিধা নাই। সব ব্যবস্থা হবে সময়মতো।

অনুরোধ করলাম, এবার ট্রেনের টিকিটের সঙ্গে হোটেলে রিজার্ভেশনের অগ্রিম ব্যবস্থা করে রাখতে চাই। সব শুনে মুচকি হেসে বললেন, তা আমি জানি বলেই তোমাদের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থার জোগাড় করে রেখেছি। জিজ্ঞেস করলাম বিশেষ আয়োজনটা কী?
আয়েশি মেজাজে জবাব দিলেন, পেয়িং গেস্ট।

দুজনের অবাক দৃষ্টির উত্তরে পকেট থেকে বের করলেন একটি ভিজিটিং কার্ড। যাতে লেখা কর্নেল (অব.) কৈলাশ মিশ্রা, ব্যারাকপুর ডিফেন্স কলোনি, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ। কার্ডটি আমাদের চোখের সামনে দোলাতে দোলাতে বললেন। চাইলে ওই কার্ডের বদৌলতে সারা ভারতে স্বল্প খরচে ও পারিবারিক পরিবেশে বেড়াতে পারো। তবে রেফারেন্স থাকতে হবে ভালো। মানে প্রথম যে বাসায় উঠবে সেখানের পেয়িং গেস্টের সব নিয়মকানুন ঠিকমতো মেনে চলতে পারলে পুরো ভারতে থাকা যাবে এই স্বল্প মূল্যের ব্যবস্থায়। শুনে একটু আশ্চর্য হলাম! মনে হলো, এই আইডিয়া মন্দ না। ভারতের প্রতিটি শহরে ঢাকার ডিওএইচ-এর আদলে গড়ে উঠেছে ডিফেন্স কলোনি। যাতে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব আবাসস্থল। বেশির ভাগ কর্মকর্তার সন্তানরা হয় দেশের বাইরে, নয়তো দেশেই অন্যত্র বসবাস করেন। শুধু স্বামী-স্ত্রী বসবাস করেন দুরুমের অ্যাপার্টমেন্টে। হয়তো বা নিঃসঙ্গতা কাটাতে পাশাপাশি সামান্য বাড়তি আয়ের জন্য এই সুন্দর স্মার্ট আইডিয়া। কার্ডে দেওয়া ফোনে যোগাযোগ করা হলো এবং বিস্তারিত সব বলা হলো। সঙ্গে সঙ্গে সেই কর্নেল দম্পতি সম্মতি দিলেন। ঠিক হলো, পরদিন সকালে যাব তাঁদের বাসায়। পরদিন সকালে ব্যারাকপুর গিয়ে থামতে হলো কলোনির অভ্যর্থনা কক্ষে। কর্নেল দম্পতির কাছে দেওয়া সব তথ্য আবার এখানে লিখে রাখল। সবকিছু লিখে কলোনির নিজস্ব অটো রিকশায় তুলে দিলেন অভ্যর্থনা কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

খানিক চলার পর আমরা গিয়ে থামলাম সুন্দর একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় কর্নেল মিশ্রার ফ্ল্যাটে। স্বামী-স্ত্রী দুজন একসঙ্গে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। বসার ঘরে বসেই, শুরু কয়েকটি প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আমরা কয়দিন থাকব কলকাতায়। শুধু কি থাকার জন্য এসেছি? না সঙ্গে খাবারও নেব ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু থাকার জন্য সার্ভিস চার্জ একরকম, তবে খাওয়া হলে ভিন্ন পরিমাণের চার্জ।

তবে ভোরবেলার চা ফ্রি। শুনে মজাই পেলাম।

খাবারের আয়োজন বেশির ভাগ নিরামিষ। তবে চাইলে মাছের ব্যবস্থাও করা যাবে। সব শুনে ঠিক হলো আমরা থাকব তিনদিন এবং শুধু রাতের খাবার নেব। আমাদের পরিচিতজনের কথাই সত্য। থাকা ও খাওয়ার খরচের পরিমাণ শুনে হতবাক। ভীষণ সস্তা।
বলা যায় নামমাত্র মূল্যে আমরা পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতে পারব। কলকাতার সাধারণ মানের হোটেলের চাইতে অর্ধেকেরও কম। বসার রুমের পাশের রুমটি অতিথিদের জন্য। লাগোয়া বাথরুমসহ ছিমছাম পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রি চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। বাসায় ফিরতে হতো রাতে দশটার আগে অবশ্যই। কলোনির রিসেপশন হতে কর্নেল দম্পতির কাছে আমাদের আসার খবর দিয়ে ফোন আসত। বাসায় ঢুকেই দেখতাম টেবিলে খাবার পরিবেশিত হচ্ছে। মাছসহ কমপক্ষে তিন পদের ব্যঞ্জন। একদিন ছিল মসুর ডাল, কাঁচা আম সহযোগে। বাড়তি ছিল খাবার টেবিলে পারিবারিক স্টাইলে গল্পবলা। দুজনই বেশ আমুদে ছিলেন। যাকে বলে খোশমেজাজি। চলে আসার আগের দিন মিলে গেল ফ্রি নাশতা। নাশতায় ছিল গরম-গরম লুচির সঙ্গে হালকা ঝোলের মজাদার আলুর দম। রাতেই অনুরোধ করছিলেন, সকালে নাশতা করে যেতে হবে। আরও বললেন, আমাদের দুজনকে খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ অনুরোধ করলেন ধূমপান ছেড়ে দিতে। যদিও বাসার ভেতরে ধূমপান করা যেত না। তাই আমরা নিচে নেমে লনে বসে ধূমপান করতাম।

পরের গন্তব্য ছিল কানপুর। আসবার দিন কর্নেল নিজে ফোন করে সব ব্যবস্থা করে দিলেন কানপুরের জন্য। কানপুরের গল্প তোলা রইল আরেক বেলার জন্য। পরদিন সকালে পেট ভরে নাশতা খেয়ে যখন অটোতে উঠতে যাব, পেছন ফিরে বিদায় নিতে গিয়ে দেখি কর্নেল (অব.) কৈলাশ মিশ্রা ও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর চোখে অশ্রু। আমাদের মনও ছিল ভারাক্রান্ত। মাত্র তিন দিনেই ওই বয়স্ক দম্পতির জন্য আমাদের মায়া লেগে গিয়েছিল। নিশ্চিত করে বলতে পারি, মিস্টার ও মিসেস কর্নেল (অব.) কৈলাশ মিশ্রার হৃদয়ে আমাদের জন্য ভালোবাসা অনুভূত হয়েছে। তাই বুঝি আতিথেয়তায় যে আন্তরিকতা ছিল, তাতে মনে হয়নি আমরা পেয়িং গেস্ট ছিলাম। খুবই সহজে আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন। আসার সময় বিলের প্যাকেটটি হাতে নিতেও কেমন যেন সংকোচ করছিলেন। আর সেটাই আমাদের ভারত মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তার আসল রূপ। হোক না পেয়িং গেস্ট অথবা আপন গেস্ট। আপ্যায়নের মাপকাঠি সবাই সমান রাখতে সদাই থাকেন অন্তঃপ্রাণ। সেটাই হলো আমাদের উপমহাদেশের ঐতিহ্য ও গৌরবের ইতিহাস।