টরন্টো বাংলা বইমেলা শুরু

টরন্টো বাংলা বইমেলার উদ্বোধন শেষে বক্তব্য রাখছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। ছবি: সংগৃহীত
টরন্টো বাংলা বইমেলার উদ্বোধন শেষে বক্তব্য রাখছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। ছবি: সংগৃহীত

‘আলোকে আঁধার হউক চূর্ণ’ স্লোগান নিয়ে ১৩তম টরন্টো বাংলা বইমেলার উদ্বোধন হয়েছে। ৬ জুলাই রয়েল কানাডিয়ান লিজিয়ন হল, ৯ ডয়েস রোডে শুরু হয়েছে টরন্টোবাসী বাঙালিদের বহুল প্রত্যাশিত দুদিনব্যাপী বাংলা বইমেলা।

টরন্টো বাংলা বইমেলার উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা পৃথিবীর ষষ্ঠতম ভাষা। এই ভাষাকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে বইমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বইমেলার মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম “জয় বাংলা” স্লোগানে সারা বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াবে।’

পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী বেলা সাড়ে ১১টায় শোভাযাত্রা দিয়ে বইমেলার শুভসূচনা হয়। শোভাযাত্রা শুরু হয় অন্যমেলার সাইদা বারীর সঞ্চালনায়। এরপর একে একে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা বিশিষ্ট অতিথি, লেখক, কবি, প্রকাশক ও শিল্পীরা মেলাপ্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করেন।

টরন্টো বাংলা বইমেলায় থাকছে সাহিত্য আলোচনা, কবিতা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আগত লেখক, কবি ও প্রকাশকদের বই প্রদর্শনী। এ বছর মেলার আহ্বায়ক হলেন সাদী আহমেদ। আয়োজক ‘অন্যমেলা’। মেলায় আগতদের জন্য আছে র‌্যাফল ড্র অনুষ্ঠান। আয়োজকেরা জানিয়েছেন, দুটি বই কিনলে একটি পুরস্কার পাওয়া যাবে।

মেলায় আসা বিশেষ অতিথিদের ফিতা কেটে, ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হয়। ফিতা কাটেন কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। অতিথিরা হলেন কবি আসাদ চৌধুরী, দিলারা হাফিজ, হাসান মাহমুদ, লেখক হুমায়ূন কবীর ঢালী, কবি হাসানাল আবদুল্লাহ, শেলী জামান খান, সালমা বাণী প্রমুখ।

মেলায় উপস্থিত ছিলেন অনন্যার মনিরুল হক, সন্দেশ প্রকাশনীর লুৎফর রহমান চৌধুরী, লেখক হাসান মাহমুদ, লেখক জসিম মল্লিকসহ টরন্টোবাসী প্রখ্যাত লেখক, কবি, শিল্পী ও সাংবাদিকেরা।

১৩তম টরন্টো বাংলা বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৬ ও ৭ জুলাই। দুদিনই বেলা ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে মেলা। আয়োজকেরা আশা করছেন, লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলায় পরিণত হবে এবারের বইমেলা। বাংলাদেশ, আমেরিকা ও কানাডার প্রথিতযশা লেখক, প্রকাশক এবং অতিথিরা অংশ নিচ্ছেন মেলায়। এবারের মেলায় নতুন সংযোজন উত্তর আমেরিকার লেখকদের প্রকাশিত নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও পরিচিতি।

টরন্টো বাংলা বইমেলায় আসা অতিথিদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
টরন্টো বাংলা বইমেলায় আসা অতিথিদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

শিশু-কিশোরদের জন্য মেলায় বিভিন্ন ইভেন্ট সংযোজন করা হয়েছে। এ ছাড়া র‌্যালি, সাহিত্য আলোচনা, কবিতা, অতিথিপর্ব, কথোপকথন, লেখক–প্রকাশক আড্ডা, সংগীত এবং বইয়ের স্টল থাকবে দুদিনের এই মেলাজুড়ে। মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত।

মেলার প্রথম দিন মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় স্বাগত বক্তব্য দিয়ে। বক্তব্য দেন আশরাফ আলী। পরে সুকন্যা নৃত্যাঙ্গন পরিচালিত নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। নৃত্য পরিবেশন করেন অরুণা হায়দার। সংগীতে ছিলেন ফারহানা শান্তা।

দ্বিতীয় পর্বে ছিল শুভেচ্ছা বক্তব্য। সঞ্চালনায় ছিলেন জসিম মল্লিক। এই পর্বে মেলায় আগত অতিথিদের মঞ্চে ডাকা হয়।

বেলা আড়াইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত ‘বর্ণে বর্ণে বাঙালি’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। বক্তব্য উপস্থাপনায় ছিলেন লেখক ও গবেষক হাসান মাহমুদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সেলিম এস এইচ চৌধুরী। 

‘বর্ণে বর্ণে বাঙালি’ বইয়ের ওপর একটি বিশেষ উপস্থাপনায় আলোচক হাসান মাহমুদ বলেন, ‘বাচ্চাদের স্কুল সিলেবাসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র-হননের ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি প্রধান উদ্দেশ্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি।’ পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে স্কুল সিলেবাস বদলে দেওয়ায় আজ পুরো জাতি বিশ্বাস করে ভারতের মুসলিমেরা সংগ্রাম করে পাকিস্তান অর্জন করেছিল এবং একাত্তরে যুদ্ধ হয়েছিল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে। অথচ দুটোই ডাহা মিথ্যা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল ওই অঞ্চলের সিংহভাগ মুসলিম, বাঙালিদের সমর্থনেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জন করতে পেরেছিল। বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরীও সিলেবাসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র-হননের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বক্তব্য রাখেন।

দুই সপ্তাহ আগে ওয়াশিংটন ডিসি বইমেলায় আয়োজক ‘আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশন’ ও জার্মান-ভিত্তিক ‘বাংলাদেশ সেক্যুলার ফাউন্ডেশন’ যৌথভাবে ‘বর্ণে বর্ণে বাঙালি’ বইয়ের লেখক ও প্রকাশককে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পদক উপহার দেয়।

ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও আলোচনার পর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আয়োজন করা হয় উত্তর আমেরিকা কবিতা উৎসব। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী। কবিতা পড়েন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, দিলারা হাফিজ, হাসানাল আবদুল্লাহ ও কবি আসাদ চৌধুরী।

বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সঞ্চালনায় ছিলেন দিলারা নাহার বাবু ও চয়ন দাস। সংগীত পরিবেশন করেন নিলাদ্রী নির্ঝরিণী কলতান, নিশীথ জোনাকি প্রশান্তি ও নার্গিস চৌধুরী।

টরন্টো বাংলা বইমেলায় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার স্টল। ছবি: সংগৃহীত
টরন্টো বাংলা বইমেলায় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার স্টল। ছবি: সংগৃহীত

বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ছিল আলমপিয়া স্কুল অব মিউজিক পরিবেশনার ছোটদের অনুষ্ঠান। এরপর ছিল অতিথিপর্ব। এই পর্বে অতিথি ছিলেন ডলি বেগম, দিলারা হাফিজ ও জয়দেব সরকার। সভাপতিত্ব করেন সাদী আহমেদ। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আয়োজন করা হয় কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান। এতে অংশ নেন কবি দিলারা হাফিজ, কবি ফেরদৌস নাহার ও লালন নূর।

পরে জসিম মল্লিকের সঞ্চালনায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন শেলী জামান খান ও কবি আসাদ চৌধুরী।

মেলায় ছিল আমন্ত্রিত সংগীতশিল্পীর পরিবেশনায় বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান। শিল্পী ছিলেন রনি প্রেস্টিস রয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দিলারা নাহার বাবু ও চয়ন দাস।

এবারের মেলায় দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা অনেক প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনন্যা, সন্দেশ, কথা প্রকাশ, অন্যমেলা ও অন্বয় প্রকাশ। লেখক জসিম মল্লিক ও প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নিজস্ব স্টল ছিল। মেলায় সারা দিন পাঠক ও ক্রেতার আনাগোনা কম থাকলেও সন্ধ্যার পরে ক্রমে মেলা জমে উঠতে থাকে। রাত ১১টায় সাদী আহমেদ সবার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রথম দিনের মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা প্রথমবারের মতো টরন্টো বইমেলায় যোগ দিয়েছে।