ভেজা রোদের বসন্তে

জেএফকে এয়ারপোর্টর চার নম্বর টার্মিনাল থেকে বের হয়ে ফরিদের গাড়ি যখন ভ্যানউইকের রাস্তায় নেমেছে, নিউইয়র্ক সময় তখন রাত নয়টা।
সামনের সারির গাড়িগুলোর পেছনের লাইটের লাল বাতি দেখে মনে হচ্ছে, বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেলে যেন লাল শামিয়ানায় রঙিন বাতির ঝালর। চলন্ত গাড়ির জানালায় তাকিয়ে থেকে এক ধরনের শূন্যতায় ভরে উঠে শায়লার মন। কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছে না। দারুণ অস্থিরতায় তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। রাস্তার পাশের বুনো ফুলের স্বর্ণাভ আভা তার মনের মধ্যে তৈরি করে দিচ্ছে নিঃসঙ্গতার তীব্র অনুভূতি।
হঠাৎ ফরিদের চোখ পড়ে শায়লার ওপর। সবুজ জিনসের ওপর চকলেট কালারের একটা কামিজ পরেছে শায়লা। দেখে বোঝাই যায় না, এই মাত্র খুলনার মোংলার এক অজপাড়াগাঁ থেকে সে দু ঘণ্টা আগে আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছে। দু-একটা কুশলাদিতে শায়লাকে একটু হালকা করতে চায় ফরিদ। শায়লার শুকনো ঠোঁট-মুখের দিকে তাকিয়ে পাশের একটা ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে একটা বার্গার আর কোক, নিজের জন্য একটা কফি নিয়ে আসে ফরিদ। কফিতে চুমুক দিতে দিতে শায়লাকে প্রশ্ন করে সে, বাইরের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিলে?
অনেকক্ষণ কোনো জবাব দেয়নি শায়লা। গুমরে ওঠা কান্না সামলে বলে, মায়ের কথা ভাবছিলাম। মাকে অসুস্থ রেখে এসেছি। নিরিবিলি কিছু কথা হয় দুজনের মধ্যে। তারপর সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যায় ফরিদের স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে। তার অ্যাপার্টমেন্টটা খুবই ছোট। কাঠের হালকা পার্টিশনের ওপারে বেডরুম। সিটিং স্পেসে শুধু একটি সোফা। তার সঙ্গেই রান্নাঘর।
ফরিদ লক্ষ্য করে, বিষণ্নভাবে চোখের পাপড়ি ঘন ঘন তুলে তার দিকে তাকাচ্ছে শায়লা। মনে হয়, তার মনে জমছে কিছু কথা কিংবা কৌতূহল; কিন্তু কীভাবে তা পাড়বে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তার চোখের ভাষা বুঝে ফরিদ তা সমাধানের চেষ্টা করে। একটিমাত্র বিছানা দেখিয়ে বলে, তুমি শোবে বিছানায় আর আমি ঘুমাব সোফায়। শায়লা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফ্রিজে রাখা কিছু খাবার বের করে আনে ফরিদ। শায়লাকে মাইক্রোওয়েভ ওভেন দেখিয়ে বলে, এটুকু গরম করে রাতের খাবার সেরে নিতে হবে।
একটু বেলা করে ঘুম ভাঙে ফরিদের। বাথরুম সেরে এসে দেখে, শায়লা রান্না ঘর গোছাচ্ছে। চা করার ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু গ্যাসের চুলোর ব্যবহার জানা না থাকায় ইতস্তত করছে। ফরিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বলল, আপাতত এটা থাক। চলো আমরা বাইরে সকালের নাশতা সেরে নেব। শায়লা বলল, ফরিদ ভাই আমাকে একটু দেখিয়ে দেন, আমি ঠিকই শিখে ফেলব। ঠিক আছে, আগে চল নাশতা সেরে আসি।
ফরিদ এখন কাজে বের হয় না। শায়লাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। ম্যানহাটন সিটির বিশেষ বিশেষ স্থাপনা ঘুরে দেখায়। পাতাল রেলে চলাচলের নিয়মকানুন শেখায়। বেশির ভাগ পাতাল ট্রেনের নাম থাকে ইংরেজি হরফে। কোনো হরফের ট্রেন কোন লাইনে চলবে, তা ইংরেজি হরফ মনে রাখলেই চলবে। যেমন ‘ই’ ট্রেনে চড়ে সরাসরি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে যেতে পারবে। শায়লাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব তালিম দিচ্ছে ফরিদ। যেন একজন আপন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর। তাই একজন বিজ্ঞ শিক্ষকের মতো সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। শায়লা শুধু হাঁ হাঁ বলেই যাচ্ছে। দুজনে হাঁটছে আর কথা বলছে।
এক সময় শায়লা চলার গতি শ্লথ করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটু থেমে বলল, এ রকম ধূলিমাখা চশমার কাচ দিয়ে দেখছেন কীভাবে? বলেই ফরিদের চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে তাতে মুখের বাষ্প মাখিয়ে ওড়নার প্রান্ত দিয়ে মুছে আবার ফরিদকে পরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চশমাটি নাকের সিঁড়ি বেয়ে একদম প্রান্তে চলে এলে শায়লা মুখে ওড়না চেপে হাসতে হাসতে হুমড়ি খেয়ে ফুটপাথে পড়ার উপক্রম হয়। এই প্রথম দুজনার চোখাচোখি হলো। ফরিদ অনেকক্ষণ শায়লার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে। শায়লার মুখাবয়বে ক্লান্তি ছড়ানো গাঢ় মেঘ। কিন্তু ফরিদের চোখে চোখ পড়তেই তার আঁখি যুগলে খেলে যায় কৌতূহলের নীলাভ আভা। ফরিদ তার শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে চাইলে অন্তরঙ্গতার অবসান ঘটিয়ে মুহূর্তেই সরে পড়ে শায়লা। ভিনদেশি ভাষায় কথা বলতে বলতে এক যুগল পরস্পরকে চুমু খেয়ে তাদের পাশ দিয়ে চলে যায়।
শায়লা এখন একাই ঘুরে বেড়ায় ম্যানহাটনের রাস্তায়। কাজ খোঁজে। যেকোনো ধরনের একটা কাজ। এত দিন তো ফরিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। এখন সে শেয়ার করতে চায়। বেচারা ফরিদ আপন মানুষের মতো দেখভাল করছে শায়লাকে।
ম্যানহাটনে চাকরি খুঁজতে গিয়ে পরিচয় হয় বাবলুর সঙ্গে। এক কনভিনিয়েন স্টোরে কাজ করে বাবলু। অনেক দিন এ দেশে আছে। নতুন অভিবাসীদের বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সে। তার মাধ্যমে শায়লা কাজ পেয়ে যায় এক বাঙালি মালিকানার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। সহকর্মী সবাই বাঙালি পেয়ে শায়লা খুবই উৎফুল্ল। মধ্য রাতে বাসায় ফিরে কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ফরিদের সঙ্গে। কিন্তু তাতে উৎসাহিত হয় না। সে চায়নি শায়লা রেস্টুরেন্টে কাজ করুক। তার ইচ্ছে ছিল শায়লা এ দেশে পড়াশোনা করে যোগ্যতা অর্জন করে ভালো কাজের সন্ধান করুক।
বেচারা ফরিদ। দীর্ঘদিন গত হলো এ দেশে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে এসেছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি গাড়ি চালকের পেশা বেছে নেয়। আজ অবধি একই পেশায় আছে। পড়ার খরচা জোগাতে অনেক টাকার প্রয়োজন বলে এ স্বাধীন পেশাকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু বৈধ কাগজপত্রের কোনো সুরাহা হয়নি আজও। তাই হয়তো আশায় বসতি করে আঁকড়ে পড়ে আছে এ দেশে। হয়তো-বা স্বপ্নের ঘোরে তাকিয়ে আছে প্রতিফলিত আলোর দিকে। রূপকথার গল্পের রাজকন্যার বেশে আজ হাজির হয়েছে শায়লা তারই আঙিনায় বসন্তের সুবাতাস হয়ে। যেন গেল দু দশকের পরে আঁকা কোনো জলরঙের চিত্রপট থেকে বেরিয়ে বেড়াতে এসেছে কেউ ফুল হাতে প্রজাপতিতে সয়লাব এ কাননে।
উৎসব আর আনন্দে এভাবেই কেটে গেল একটি বছর। শায়লা মুগ্ধ হলো ফরিদের অকৃত্রিম মানবতার সান্নিধ্যে এসে। সে ধীরে ধীরে ভুলতে লাগল, তার বাপ–মায়ের অসহায়ত্বে বাগ্‌দত্তা জীবনের কথা।
একদিন খোশগল্পে মশগুল হয়ে সৌজন্যবশত ফরিদ প্রস্তাব করে বসে, দেখ শায়লা আমরা দুজন যেভাবে বসবাস করছি এটাকে ইংরেজি পরিভাষায় বলে ‘লিভ টুগেদার’। এটা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। আমার বন্ধু-বান্ধবের কাছে বারবার প্রশ্নবদ্ধ হচ্ছি। তাই বলছিলাম, তোমার পেরেন্‌টসের মতামত নিয়ে আমরা শুভ কাজটা সেরে নিলে কি ভালো হতো না? শায়লা জানত, এ প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে। তাই কোনো ভণিতা না করে সেও আগ্রহ দেখিয়ে বলে, হাঁ আমিও তাই ভাবছি। কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে শায়লার কানে ভেসে আসে বাঁশরির করুণ মূর্ছনার সুর ব্যঞ্জনা তাকে ব্যাকুল করে তোলে। তির্যকভাবে নাড়া দেয় তার হবু স্বামীর দেনার দায়ের কথা। যার কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা নিয়ে তার মা-বাবা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে শায়লাকে আমেরিকায় পাঠিয়েছে।
ফরিদ ইতস্তত করে প্রশ্ন করে, এত কী ভাবছ শায়লা!
শায়লা কোনো জবাব দিতে পারেনি, মুহূর্তেই যেন তাকে বিরাট ডিপ্রেশনে পেয়ে বসেছে। বারবার ভেসে উঠছে মল্লিক সরকারের কথা। যার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে আমেরিকায় এসেছে এবং তার মা-বাবা রাজি হয়েছিল টাকার বিনিময়ে কন্যাদান করবে বলে।
পরদিন মধ্য রাতে ফোন পেয়ে শায়লার ঘুম ভাঙে। অপর প্রান্ত থেকে মায়ের ভীষণ আকুতি। শয়তান মল্লিক খুবই জ্বালাচ্ছে। বলছে, মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে এনে আমার সঙ্গে তার বিয়ের ব্যবস্থা করা না হলে এর ফল ভালো হবে না। তল্লাটের মস্তান হিসেবে মল্লিক এক বাক্যে পরিচিত। তার দাপটে এলাকাবাসী ভীত।
মায়ের ফোন পেয়ে শায়লা একেবারে নার্ভাস হয়ে গেল। শ্যাম রাখে না কূল রাখে, এই মনঃকষ্টে তার দিন–রাতের অবসান হতে চায় না। চেতন–অবচেতনের দোলাচলে বহুক্ষণ। এ যেন অলীক কোনো ঝড়ের পূর্বাভাসের অন্তর্গত আবেগ।
দিন পাঁচেক পর অচেনা পারফিউমের সুরভি ছড়িয়ে ফরিদের কাছে আসে শায়লা। খানিক ঝুঁকে তার পাশে বসে। তারপর উষ্ণ নিশ্বাসে ফরিদের পাঁজর কাঁপিয়ে, আহ্লাদী ভঙ্গিতে বলে, ‘মা ফোন করেছিল। আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে এবং সম্ভব হলে এ সপ্তাহের মধ্যে। এ পর্যন্ত বলে সে ফরিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ম্লান হেসে চলে গেল। শায়লার হঠাৎ এমন আচরণে ফরিদ মারাত্মক অবাক হলো।
ইস্ট রিভারের পার ধরে হাঁটতে শুরু করে ফরিদ। এমন জটিলতা কখনো কখনো সৃষ্টি করে তীব্র স্ট্রেস। তখন নদীতীর তার একমাত্র অবলম্বন। আজকাল এটা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।