নীলাঞ্জনার চোখে জল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাসপাতালের বারান্দায় বসে যত দূর চোখ যায় শুধু তাকিয়ে থাকি। দূরের আকাশে কত রঙের মেঘ দেখি আপন মনে। সময় ছোটে তার নিজ গতিতে। তার কোনো বাধা ধরা হিসেব নেই। কিন্তু আমার সময় যে শুধু হাসপাতালের বিছানা অথবা বারান্দার মধ্যেই সীমাবদ্ধ! এখানে কত রকমের যে রোগী আছে! কারও সঙ্গেই তেমন কথা হয় না। সবাই শুধু আমাকে এড়িয়ে যায়। কারও কারও ফিসফিস শব্দ কানে ভেসে আসে। ওরা বলে, আমি নাকি পাগল। আমি একা একা কথা বলি, চিৎকার করি, রাগ হলে নিজের গায়ে চিমটি কাটি। কিন্তু কেন করি এসব?
আমার নাম নীলা, বাবা-মায়ের আদুরে একমাত্র সন্তান। কিন্তু তারাও জানে না এখন আমি কোথায়, কেমন আছি। খুব ভোর থেকে বৃষ্টি পড়ছে। আমার খুব প্রিয় মুষলধারার এ বৃষ্টি।
আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বৃষ্টির মধ্যে। শরীরটা যদি ভালো থাকে আর তখন বৃষ্টি ঝরে, আমি ঝটপট লিখতে বসে যাই। আমার তখন বয়স ১২-১৩ হবে। বাবা আমাদের নিয়ে এলেন বিদেশে। মা-বাবা দুজনই চাকরি করতেন। মা আমাকে স্কুল থেকে বাসায় এনে ঘরের কাজে ব্যস্ত হতেন, কিংবা ফোনে কথা বলতেন। এর ফাঁকেই খেতে দিতেন আমাকে। বিকেলে পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে খুব খেলতাম। পড়ালেখায় মোটামুটি ভালোই ছিলাম।
যখন আমি হাইস্কুলে যাই তখন বন্ধুর অভাব ছিল না। স্কুলের পরে সিটিতে যাওয়া কিংবা শপিংমলে যাওয়া—এভাবেই সময় গড়িয়ে যায়। আমি একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করতাম উইকএন্ডে। আমাদের বয়সের কম বেশি সবারই ছেলে বন্ধু ছিল; ছিল না আমার। ওরা আমাকে ইন্ডিয়ান বলে গালি দিত। স্কুলের বাইরে ওরা সিগারেট খেত। কেউ কেউ ড্রাগ নিত।
আমি তখন নিজের ওপর জেদ করলাম। ওদের মতো না হলে চার বছর শেষ করা কঠিন হয়ে আসছিল। তাই একদিন সবাই মিলে চলে গেলাম সেন্ট্রাল পার্কে। আমরা সবাই এক একজন সিগারেট ধরালাম। সবাই ঠিক ছিল কিন্তু আমি শর্ট ব্রিদিং ফিল করলাম। চোখ লাল হয়ে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। কিছুক্ষণ পরেই বমি করে ফেললাম। এক বন্ধুর সহযোগিতায় বাসায় পৌঁছেছিলাম সেদিন।
মা বাসায় না থাকায় প্রথম দিন একভাবে কাটে। এরপর ছুটির দিনে সবাই মিলে ফার রকওয়ে কিংবা কোনি আইল্যান্ডে চলে যেতাম। ধীরে ধীরে মাদকে অভ্যস্ত হলাম। পরিবারকে ফাঁকি দেওয়ার কৌশলও বুঝে গেছি। এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল নতুন স্টুডেন্ট অঞ্জন। খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল আমার। আমরা ভালোবাসার সাগরে ভাসতে লাগলাম। একদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের কোনো ছাতা না থাকায় ভিজে দুজনে ঘোরাঘুরি করি। বাসায় ফিরতেই মা আমাকে অকথ্য ভাষায় বকাবকি করলেন। কারণ মাকে কেউ বলে দিয়েছে আমাদের সম্পর্কের কথা। সব সহ্য করলাম। কারণ মা আমার ভালোই চান। কিন্তু পরদিন ঘটল ভিন্ন ঘটনা, বাসায় ফিরে দেখি বাবা-মাসহ আমার এক বন্ধুও আছে।
বাবার চিৎকার, মায়ে বকুনি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার বন্ধু শুধু বলল, তাঁরা সব জেনে গেছে, জেনে গেছে ড্রাগস, সিগারেট আর অঞ্জনের কথা।
আমি রুমে আসলে মা বললেন, তুমি আমাদের সন্তান হয়ে এসব করে বেড়াচ্ছ? একটা হিন্দু ছেলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক? তোমার বাবা বলেছে, তুমি আর আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না। সমাজে তোমার জন্য আমরা এভাবে নিচু হতে পারব না।
বাবা-মা দুজনেই আমাকে মারধর করলেন। আমিও জেদ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাই ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে। বাইরে বের হয়ে কিছু দূর যেতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। কোথায় যাব জানি না। সাবওয়েতে এসে ভাবতে ভাবতে রাত পার হয়ে গেল। পরদিন বন্ধুদের বললাম আমার কথা। ওদের জন্য কিছুদিন রুমমেট হয়ে থাকলাম কারও সঙ্গে। তাদের টাকা-পয়সা চুরি হলেই আমার দিকে আঙুল তুলত তাঁরা। বাসা ছেড়ে চলে আসি অন্য জায়গায়। এখন আমি কাজের পাশাপাশি নিজের প্রতিও খেয়াল রাখতে শিখেছি। এর জন্য অঞ্জন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি আর অঞ্জন ভালো থাকলেও মাঝে মাঝেই ও ঘড়ি দেখে বলত যেতে হবে এখন। আমি তোমার মতো পরিবার ছেড়ে থাকতে পারব না।
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী তবে শুধু শারীরিক সম্পর্কের জন্যই আস? অনেক রাগ হলাম। প্রায় এক সপ্তাহ ও আর আসেনি। পরে আসেনি কয়েক মাস। এরপর বছরও গড়িয়ে গেছে। ভুলেও যেন ভুলতে পারিনি, হঠাৎ কখনো মনে হলে কষ্ট পাই।
অঞ্জনকে খুব মিস করতে শুরু করলাম। মনকে শক্ত করতে পারছি না। হঠাৎ একদিন বেল বাজতেই দেখি ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে অঞ্জন। আমার সেদিনের আনন্দটা যেন নিমেষেই মিলিয়ে গেল। অঞ্জন যাওয়ার সময় হঠাৎ বলল, আমার বাবা অসুস্থ হয়ে এখন হাসপাতালে কোমায় আছেন। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভিজিটিং আওয়ার না থাকায় দেখা হলো না বাবার সঙ্গে। পরদিন কাজে না গিয়ে সোজা হাসপাতালে গেলাম, কাউকে না দেখে জানতে পারলাম আমার বাবার মৃতদেহটা সকালেই বাসায় নেওয়া হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বাসে করে আমাদের বাসায় আসলাম। মায়ের সঙ্গে তখন অনেক আত্মীয়স্বজন ছিলেন। কেউ কেউ আমাকে দেখে বাজে কথা বলতে শুরু করল। সব সহ্য করে মায়ের কাছে আসতেই মা বললেন, তুমি চলে যাও, আমি আর নতুন করে তোমার জন্য কষ্ট পেতে চাই না। সবাই তখন যেন বাবার মৃত্যুর চেয়ে আমাকে নিয়েই কথার ফোড়ন কাটতে শুরু করল। আমি আর থাকতে না পেরে চলে এলাম। সেদিন আমি অনেক নেশা করেছিলাম। এ কারণে পরদিন আর কাজে যাওয়া হয়নি। কালের প্রবাহের মতো দ্রুত সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল।
আমি আর অঞ্জন সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আর নয়, বিয়ে করি আমরা। দিন ঠিক হলে আমরা দুজন আলাদাভাবে কিছু শপিং করলাম। বিয়ের তিন দিন আগে আমি আপ স্টেটে গিয়েছি কিছু কিনতে, দেখি আমার এক স্কুলের বন্ধু। আনন্দে আমরা বসে পড়লাম কফিশপে। আমি ওকে অঞ্জনের সঙ্গে বিয়ের কথা বলতেই ও বলতে শুরু করল, অঞ্জন একটা ফ্রড ছেলে। ও এর আগেও মেয়েদের ফুসলিয়ে সম্পর্ক করেছে। বিয়ে করেছিল। কিন্তু টেকেনি।
আমি যেন ঘোরের মধ্যে কথাগুলো শুনছিলাম। ওর সঙ্গে ওর বাসায় যাই। এরপর ও আমাকে প্রমাণের জন্য পুরোনো ছবি দেখাতে দেখাতে অঞ্জনের ছবি দেখায়। আমি দেখি অঞ্জনের রোমান্টিক ছবি। তার সঙ্গের মেয়েটাও আমাদের বন্ধু ছিল। বুঝতে আর কিছু বাকি ছিল না আমার। বাসায় এসে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি। অতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ায় আমার অর্ধমৃত অবস্থা। সুপার ৯১১-এ কল করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সুপারের কাছে শুনে অঞ্জন আমাকে দেখতে এসেছিল। আমি সকালের নাশতার কাটা চামচ দিয়ে ওকে মারতে গিয়েছিলাম। আমার নামে এখন মার্ডার কেস ঝুলছে। আমি মানসিক রোগী হয়ে গেছি।
পৃথিবী আমার কাছে শুধুই নির্মম। তার কোনো রং নেই। নেই কারও ভালোবাসা। আকাশ যেন আমার কাছ থেকে ধার নিয়েছে চোখের সব জল। তাই তো সে অঝোর ধারায় ঝরছে আবার আজ।