আসুন আওয়াজ তুলি

বাংলাদেশের বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবর বিশ্লেষণ করে সহজেই বলা যায় কথাটি। ২০১৭, ’১৮ ও ’১৯ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৩৯টি। তার মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি। বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ৪৭ শিশুর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৩৯ জন। নয় মাসের শিশু আপন চাচার হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। কতটা বিকৃত মানসিক অবস্থায় আমরা পৌঁছেছি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাহলে বলতেই হয়, বাংলাদেশে এখন ধর্ষণ মহামারির রূপ নিয়েছে। আর ধর্ষণের ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় চার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তুলনামূলক অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ২৩ হাজারটি ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে মামলা দায়ের হয়েছে। গত পাঁচ বছরে ‘ধর্ষণের’ শিকার প্রায় ৩ হাজার শিশু। নারী ও কন্যা শিশুদের ওপর নির্যাতনের বার্ষিক এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে সংখ্যা কম বেশির চেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো নির্যাতনের ধরন ও মাত্রা নিয়ে। শিশু ধর্ষণ ও খুন বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। তীব্র প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে সর্বত্র। বিশ্বজুড়ে ধর্ষণ নিউজ পোর্টাল ঘেঁটে জানা যায়, পুরো পৃথিবীর সর্বত্রই প্রায় ৩৬ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সাত শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
পত্রিকার সংবাদ থেকে জানতে পরি, একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্তত চার লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাস্তবে এই সংখ্যাটি হয়তো আরও বড়। একাত্তরে কোনো কোনো নারী প্রতিদিন ৭০-৮০ বারও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রায় ২০ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। রুয়ান্ডায় এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ, কঙ্গোতে সাড়ে চার লাখ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ ও সংঘাত চলাকালে এই পরিসংখ্যান প্রায় একই রকম।
জেনেভা কনভেনশনে ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে জাতিগত দমনের উদ্দেশ্যে এবং সেই ব্যবহার এখনো চলছে। যুদ্ধের ময়দানে ধর্ষণকে অন্যান্য মারণাস্ত্রের মতো একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
ধর্ষণের অধিকাংশ অভিযোগ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন অসংখ্য ধর্ষণের খবর, ছবি, ভিডিও দেখে নানা বয়সের মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এর কোনো রকম চিকিৎসা হওয়ার সুযোগ আমাদের সমাজে নেই। পুলিশ বলছে, বিকৃত মানসিকতা ও মাদকাসক্তির কারণে সমাজের এমন অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পুলিশ সব সময় এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপর থাকে এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর।
রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এই ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না৷ আমরা বারবার বলেছি, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মনিটরিং কমিটি করার জন্য, কিন্তু তা করা হচ্ছেনা৷ আর যেসব ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তার ২০ ভাগের বেশি থানায় মামলায় দায়ের করে না। শতকরা এক ভাগেরও কম সাজা হয়। শুধু চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আড়াই শ–এর বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ।
আসলে ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক নয়, ধর্ষণকারীর বিকৃত মানসিকতাই এককভাবে দায়ী। ধর্ষণকারী কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ নয়। ধর্ষণকারী নারীর পোশাক, বয়স, আচরণ কোনো কিছুই আমলে নেয় না। বিকৃত কাম চরিতার্থে নারীরা এদের শিকার হয়। এদের দরকার উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সেই সঙ্গে যথাযথ চিকিৎসা।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বিচার না পাওয়ায় এখন অনেকেই আর মামলা করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ধর্ষণকারী শক্তিশালী বলে ভয়ের কারণেও অনেকে মামলা করতে সাহস পায় না। ক্ষমতা আর বিত্তের কাছে বিচারপ্রার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন।
সমাজের অবক্ষয় এতই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মাদ্রাসা শিক্ষক থেকে স্কুলশিক্ষক, অধ্যক্ষকে পর্যন্ত ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এখন কথা হলো, শুধু বিচারিক বিলম্বের কারণেই এমন ধর্ষণের মাত্রা বেড়েছে বলে আমি মনে করি না। নৈতিকতার অবক্ষয় সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ বলে মনে করতে চাই। রাজনৈতিকভাবে সব ধরনের স্ট্রাকচার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে এসব হচ্ছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দুর করতে হবে।
আসুন ধর্ষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। সমাজে সচেতনতা তৈরি করি। প্রতিবাদ জানাই। চাই, বিচার চাই। বিচার করে সাজা দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করি। প্রতিরোধ গড়ে না তুললে এর থেকে মুক্তির উপায় নেই।