এখন তিনি মিষ্টির কারিগর

নিজের তৈরি মিষ্টির সামনে মোশাররফ হোসেন
নিজের তৈরি মিষ্টির সামনে মোশাররফ হোসেন

ঘি বানাতেন তিনি। বিশুদ্ধ ঘি। সেগুলো সরবরাহ করতেন বিভিন্ন কোম্পানিতে। কোম্পানিগুলো আবার সেই ঘি নিজেদের মতো করে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়তেন। মুন্সিগঞ্জের মোশাররফ হোসেন বেশ আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন ঢাকার ঘি প্রস্তুতকারকদের কাছে।
‘শ শ কেজি দুধের সর কিনতাম। জনে জনে টাকা দিয়ে রাখতাম। তারা সর সাপ্লাই দিত। সর বিক্রেতাদের একটা বড় চেইন তৈরি করেছিলাম। এরপর কী হলো, হঠাৎ করে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।’—বলছিলেন মোশাররফ হোসেন। ঘি বানানো আর বিক্রির পেশা ছেড়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এখন নামকরা মিষ্টি-কারিগর। লাল-কালো মিষ্টি বানান। হরেক রকম মিষ্টি।
বয়স তাঁর ষাটের ঘর ছুঁয়েছে এক বছর হলো। এখনো নিরলস তাঁর জীবনসংগ্রাম। মঙ্গলবার মধ্যরাতে কথা মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড অ্যাভিনিউতে রাঁধুনি রেস্টুরেন্টে। ‘রসমালাই’ আর ‘লালমোহন’ বানিয়ে মাত্র শেষ করেছেন। জানালেন, অন্তত ৫০ ধরনের মিষ্টি আর দই বানাতে পারেন তিনি। তবে, বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে ৭/৮ ধরনের বেশি চলে না।’
২০১০ সালে সমৃদ্ধির স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন মোশাররফ হোসেন। পরিচিত একজনের সূত্রে তাঁর গন্তব্য ছিল টেক্সাসের হিউস্টন। সেখানেই পরদিন থেকে নেমে পড়েন জীবনসংগ্রামে। বাংলাদেশি এক রেস্টুরেন্টে কিচেনে সাহায্যকারীর কাজ দিয়ে শুরু। বললেন, ‘সেখানে আমার গুরু ছিলেন এক পাকিস্তানি। ১৫ মাস ছিলাম সেখানে। প্রথম ৭ মাসেই তাঁর কাছ থেকে শিখে ফেলি মিষ্টি আর দই বানানোর কাজ। এজন্য, তাঁর বিশ্বাসভাজন হতে হয়েছে আমাকে। অতিরিক্ত সময় দিয়েছি। মনোযোগও।’ মোশাররফ বলেন, মিষ্টি তৈরির কাজে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। এই কৌশল যিনি যত বেশি রপ্ত করতে পারেন, তার মিষ্টি তত বেশি স্বাদের হবে। নইলে হবে চিনির দলা। এই কৌশল আবার দেখে শেখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য গুরুর শিক্ষা প্রয়োজন। তিনি যদি কৌশল বলে না দেন, তাহলে তাঁর সঙ্গে বছরের পর বছর থেকেও কাজটা শেখা সম্ভব নয়।

নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ কীভাবে এল তাও জানালেন মোশাররফ। বললেন, যার কাছে কাজ শিখেছিলাম, তিনি এক সময় চাকরি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেলে মিষ্টি বানানোর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। মনে আছে, আমার প্রথম দিনের মিষ্টি নিয়ে মালিক আর তার বন্ধুর সে কী বিস্ময়!’
টেক্সাসে ১৫ মাস থেকে নিউইয়র্কে আসেন মোশাররফ হোসেন। বললেন, ‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের প্রায় সবাই এখানে। তা ছাড়া, আমি যেখানে থাকতাম, জায়গাটায় লোকজন কম। বাংলাদেশি কম।’
নিউইয়র্কে এসে মোশাররফ যোগ দেন জ্যাকসন হাইটসে সে সময়ের রেস্টুরেন্ট ফুড কোর্টে, বর্তমানে যেটি ইত্যাদি গার্ডেন নামে পরিচিত। ব্রুকলিনের রাঁধুনিতে যোগ দিয়েছেন প্রায় দুই বছর আগে। এখানে তিনি ৮ ধরনের মিষ্টি তৈরি করেন।
‘আমি মিষ্টি বানাই যিনি খাবেন তার স্বাদ-সন্তুষ্টির জন্য। শুধু মালিকের লাভ দেখতে গেলে একসময় ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এক পাউন্ড ছানাতে আমি মিষ্টি বানাই ২ পাউন্ড। পাকিস্তানিরা বানায় ৪ থেকে ৫ পাউন্ড। আমাদের দেশে বানায় ৩ সাড়ে তিন পাউন্ড’—বললেন মোশাররফ। তিনি যুক্তি দেখান, মিষ্টি ভালো হলে ক্রেতাদের আস্থাভাজন হওয়া যায়। এটা বড় অর্জন। এটাও একটা মুনাফা। বললেন, ছানা তৈরি, এরপর সেগুলোর সঙ্গে অন্য উপাদান মেশানো এবং সবশেষে চুলায় ২০/৩০ মিনিট ধরে শিরায় মিষ্টিটা সেদ্ধ করা পর্যন্ত সময়ে কিন্তু খরচ কমানোর কিছু উপায় থাকে।
এক ছেলে আর তিন মেয়ের বাবা মোশাররফ হোসেন এ দেশে এসেছিলেন ভ্রমণ ভিসায়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন প্রায় ১০ বছর। ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসের কারণে আসার পর থেকে তাঁর আর দেশে যাওয়া হয়নি। বললেন, ‘দেশে অনেক কিছু মিস করি, পরিবারকেও। তবে, ইন্টারনেটের কারণে, তাদের দেখতে পারি বলে, মন কিছুটা হলেও হালকা হয়।’
দেশে যাবেন না?—এমন প্রশ্ন করতেই মুচকি হাসলেন মোশাররফ হোসেন। বললেন, ‘আগামী বছরের শুরুতে যাচ্ছি।’ বলেই বসা থেকে উঠে কিচেনের পথে পা বাড়ালেন। তাঁর অভিব্যক্তি তখন কোন যুদ্ধজয়ের গল্প বলছিল যেন।
–আবার ফিরতে পারবেন তো?
–অবশ্যই।