বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার পরে জামিনে মুক্ত

মোস্তাকুরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে  যাচ্ছে পুলিশ
মোস্তাকুরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ

বাংলাদেশি প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নয়টি কম্পিউটার চুরির অভিযোগে এক বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে নিউইয়র্ক পুলিশ। অবশ্য গ্রেপ্তারের পর দিনই তিনি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।

প্রতারণার অভিযোগ ওঠা নিউইয়র্কপ্রবাসী ওই বাংলাদেশির নাম মোস্তাকুর রহমান (৪৯)। ৫ জুলাই বিকেলে জ্যামাইকার হিলসাইড অ্যাভিনিউ এলাকার একটি দোকান থেকে ১০৭ পুলিশ স্টেশনের অফিসার তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

মোস্তাকুর রহমান তাঁর বিরুদ্ধে আনা প্রতারণা ও চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে তাঁকে হেয় করার জন্য একটি চক্র ষড়যন্ত্র করে তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে। কম্পিউটার চুরি হওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির নাম ‘সাউথ এশিয়ান ফান্ড ফর এডুকেশন, স্কলারশিপ অ্যান্ড ট্রেনিং’ সংক্ষেপে স্যাফেস্ট। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মাজেদা এ উদ্দিন। তিনি অভিযোগ করেন, গত জানুয়ারি মাসে কুইন্সের বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যামাইকার ১৬৯-১৮-এ, দ্বিতীয় তলায় মোস্তাউর রহমানের (মোস্তাকুর রহমান) মালিকানাধীন এমআরটি গ্রুপ এলএলসির অফিসের একটি কক্ষ আমি ভাড়া নিই। ৬ মে স্যাফেস্ট-এর অফিস উদ্বোধন করেছি। সেখানে উদ্যোমী প্রবাসীদের কম্পিউটার শেখানোর পাশাপাশি ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ ও শিক্ষা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় ওই ভবনের মালিক ৮/৯ মাসের বকেয়া ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে মোস্তাউরের বিরুদ্ধে কুইন্স কোর্টে মামলা করেন। একপর্যায়ে ১৭ জুন আদালতের নির্দেশে নিউইয়র্ক সিটি মার্শাল রোনাল্ড ডব্লিউ পেজান্ট সেই ভবনে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভবনের মালিক ছাড়া আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারবে না। 

মাজেদা দাবি করেন, আদালতের আদেশর বিষয়টি জানার পর বিব্রতকর অবস্থা ও চিন্তায় পড়েন তিনি। কারণ, তাঁর অফিসে ১৭টি কম্পিউটার, নগদ অর্থসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রয়েছে। নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা সত্ত্বেও কেন তিনি মোস্তাউরের কাজে ক্ষতির শিকার হলেন—এমন প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে তাঁকে। এরই মধ্যে মাজেদা জানতে পারেন, মার্শাল কর্তৃক ওই ভবনে তালা দেওয়ার আগেই মোস্তাউর সব কটি কম্পিউটার সরিয়ে ফেলেছেন।

মাজেদা আরও দাবি করেন, ১ জুলাই তিনি নিশ্চিত হন, অন্তত ৪টি কম্পিউটার জ্যামাইকার একটি দোকানে বিক্রির পাঁয়তারা চলছে। ঘটনাটি পুলিশের দৃষ্টিতে দেওয়ার পর ৫ জুলাই বিকেলে ওই দোকানে অভিযান চালায় পুলিশ।

মাজেদা উদ্দিনের অভিযোগ প্রসঙ্গে মোস্তাকুর রহমান দাবি করেন, ‘তিনি আমার অফিসে সাবলেট হিসেবে কক্ষ ভাড়া নেন। প্রথম মাসের ভাড়া পরিশোধ করলেও পরবর্তিতে বেশ কয়েক মাসের ভাড়া পরিশোধ করেননি। তার কাছে ভাড়া চাইলে, উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আমিও তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।’

এদিকে, কুইন্সের এক প্রবাসী বাংলাদেশি শামসুল হক অভিযোগ করেন, তাঁর কাছ থেকে মোস্তাকুর ৫ হাজার ডলার নিয়েছেন। এই অর্থ নেওয়ার বিনিময়ে তিনি তাঁকে ওয়ার্ক পারমিট, সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর সংগ্রহ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কন্সট্রাকশন ঠিকাদারের লাইসেন্স করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর কাছে আরও ৯ হাজার ডলার চেয়েছিলেন। কিন্তু এখনো তাঁকে ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে দিতে পারেননি। ভুয়া সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর দিয়েছেন। সেই নম্বর নিয়ে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের কার্ড করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন শামসুল হক।

শামসুল হক অভিযোগ করেন, মোস্তাকুর নিজেকে ইমিগ্রেশনের অ্যাটর্নি পরিচয় দিয়ে তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিস্তারিত আবেদনে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এজন্য ইতিমধ্যে তাঁর কাছ থেকে ৫ হাজার ডলার পরিমাণ অর্থ নেন। এখন শামসুল হক নিশ্চিত হয়েছেন, মুস্তাকুর প্রকৃতপক্ষে অ্যাটর্নি নয়। তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোস্তাকুর জ্যামাইকার মত ম্যানহাটনেও একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন। সেটির ভাড়া বাবদ দুটি চেক দেন। একটি চেক দিয়েও অর্থ তুলতে পারেননি ওই কক্ষের মালিক। বিজ্ঞাপনের বিল বাবদ নিউইয়র্কে বাংলা ভাষার কয়েকটি পত্রিকাকেও একই ধরনের বেশ কয়েকটি চেক দিয়েছেন। প্রত্যেকেরই চেক বাউন্স হয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টে কোনো অর্থ না থাকায় পত্রিকাগুলোকে উল্টো জরিমানা দিতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লার বুড়িচংয়ের বাসিন্দা মুস্তাকুর ২০১৪ সালে আমেরিকায় এসেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের অকল্যান্ড সিটিতে ১৪৬০ ব্রডওয়েতে তাঁর একটি অফিস ছিল। সেখানকার ভিজিটিং কার্ডে নিজেকে এমআরটি গ্রুপের এমডি বলে উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষাগত যোগ্যতার মধ্যে লেখা রয়েছে কানাডা থেকে এমবিএ ও এমএসএস করেছেন। ব্যবসা প্রশাসনে পিএইচডির ছাত্র ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে।

মোস্তাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা বলছেন, তাঁর সবকিছুই মিথ্যা। কারণ, তার চাল-চলন ও কথাবার্তায় কোনোভাবেই উচ্চশিক্ষিত বলে মনে হয়নি।

সত্যিই তিনি ইমিগ্রেশনের অ্যাটর্নি কিনা জানতে চাইলে মোস্তাকুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অ্যাটর্নিশিপ করেছি কানাডায়।’ আমেরিকায় কীভাবে আইনজীবী হিসেবে ব্যবসা করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘নেটওয়ার্ক’-এ অ্যাটর্নিশিপ করেছি।’

মোস্তাকুরের উভয় তথ্যই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। নেটওয়ার্কে কোনো ডিগ্রি অর্জনের বিধি নেই আমেরিকায়। এ ছাড়া, আইনজীবীর ব্যবসা করতে হলে আমেরিকার যেকোনো অঙ্গরাজ্যে বার কাউন্সিলের মেম্বার হতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়।

মোস্তাকুর রহমানের স্ত্রী খোদেজা সুলতানা সাথী বলেন, ‘আমার স্বামীকে সরল বিবেচনা করে একশ্রেণির জটিল লোক তাঁর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারে নেমেছে। অনেকের অর্থ পরিশোধ করার পরও এখনো তারা সুযোগ গ্রহণ করছে। বেকায়দায় পেয়ে বাড়তি লাভের আশায় তারা এমনটি করছেন। সময়েই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’