ওবামার প্রতি 'আক্রোশ' থেকে ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল!

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি ‘আক্রোশ’ থেকে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করেছিলেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার কিম ডারোখের ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে এমন তথ্য জানা গেছে। ২০১৮ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন পারমানবিক চুক্তি বহাল রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় ওই নথিটি লেখা হয়।

স্যার কিম ডারোখে পুরো বিষয়কে ‘কূটনৈতিক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড’ বলে বর্ণনা করেন। যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র মেইলের বরাত দিয়ে আজ রোববার বিবিসি অনলাইন এ খবর প্রকাশ করে।

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীন পারমাণবিক চুক্তি করে। এই চুক্তির আওতায় ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ দেশ ইরান ইউরেনিয়াম উৎপাদন সীমিত করে। ইউরেনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে বারাক ওবামার সময়ে হওয়া ওই চুক্তি নিয়ে বরাবরই বিরোধিতা করে আসছিলেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ওই চুক্তি বাতিল করবেন। সেই ঘোষণা ঠিক রেখে গত বছরের মে মাসে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেন। ইরান চুক্তি লঙ্ঘন করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে—এই অজুহাত দেন তিনি। পাশাপাশি ইরানের ওপর নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। তবে বিষয়টি শুধু এই পর্যন্তই থাকেনি। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে হামলা করতে পারে—নিজ দেশের এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। সবশেষ ওমান উপসাগরীয় এলাকায় তেলবাহী ট্যাংকারে হামলার ঘটনায় ইরান জড়িত দাবি করলে দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও ইরান তা অস্বীকার করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে পারমাণবিক চুক্তিতে থাকা বাকি দেশগুলোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ছবি: এএফপি
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ছবি: এএফপি

সংবাদপত্র মেইলের তথ্য অনুসারে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রদূত স্যার কিম ওই নথি লেখেন। এতে তিনি জানান, ‘ব্যক্তিগত কারণে’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। কারণ, চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার সময়ে।

রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এবং চুক্তিটি প্রত্যাহারের পর হোয়াইট হাউস প্রতিদিনকার করণীয় ঠিক করেনি বলেও উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, ‘আপাত স্ববিরোধী মনে হলেও যে বিষয়টি বাস্তবতাবিবর্জিত নয়, হোয়াইট হাউসের সেই চিত্রই যেন উঠে এসেছে: আপনি অনন্য প্রবেশাধিকার পেয়েছেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রেখে সবাইকে দেখছেন, তবে সার কথা হচ্ছে, প্রশাসন কূটনৈতিক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ওপর আসীন হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মতাদর্শ ও ব্যক্তিগত কারণে—কারণ এটা ওবামার চুক্তি ছিল। সর্বোপরি, তারা (হোয়াইট হাউস) প্রতিদিনের কৌশলগত দিকটি স্পষ্ট করতে পারছে না এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের লোকজন আজ সকালে জানিয়েছেন, ইউরোপ বা এ অঞ্চলের অংশীদার ও মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁদের।’

এ তথ্য এমন সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড গণমাধ্যমকে গোপন কূটনৈতিক স্মারক প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্ক করেছে। তারা সাংবাদিকদের সতর্ক করেছে, সাবেক রাষ্ট্রদূতের আর কোনো গোপন নথি প্রকাশ করলে তা সরকারি গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের শামিল হবে। এক সপ্তাহ আগে সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের প্রকাশ হয়ে পড়া গোপন নথি থেকে জানা গেছে, তিনি ট্রাম্প প্রশাসনকে ‘আনাড়ি ও অযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার কিম ডারোখ। ছবি: টুইটার
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার কিম ডারোখ। ছবি: টুইটার

এদিকে এসব নথির ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি রাষ্ট্রদূত স্যার কিমকে ‘অতি নির্বোধ ব্যক্তি’ বলে মন্তব্য করেছেন।

গত বুধবার রাষ্ট্রদূত হিসেবে পদত্যাগ করেছেন করেছেন স্যার কিম। তিনি বলেছেন, দায়িত্ব পালন করা তাঁর জন্য ‘অসম্ভব’ হয়ে পড়েছে। তাঁর পদত্যাগের পর গোপন নথি প্রকাশের উৎসের সন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে যুক্তরাজ্য পুলিশ। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সহকারী কমিশনার নেইল বাসু বলেছেন, জনস্বার্থে নেপথ্যের ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

তবে এসব গোপন নথি প্রকাশে সাংবাদিকদের সতর্ক করা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে মেইল কর্তৃপক্ষ তাদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, এটায় জনস্বার্থ জড়িত। তাই ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিলে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্তরাজ্যের থামানোর চেষ্টার ব্যাপারে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিক্রিয়ায় এটাকে কোনো ‘খবর নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। তিনি সংবেদনশীল গোপন নথি প্রকাশকে ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ইরানকে প্রতিহত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতবিরোধ ছিল—এটা কোনো ‘খবর নয়’।