কবিতার এক পাতা

“কাব্য শরীর—যাকে আচার্য ভামহ বলেছেন ‘কাব্যময়ং বপুঃ’—তা মানব শরীরের মতো স্বল্পস্থায়ী ও মরণশীল নয়। তা বস্তুত যুগযুগান্তরস্থায়ী ও সেই অর্থে অবিনশ্বর।
যেহেতু কবির বাণীমূর্তি তাঁর রচিত কাব্যশরীর কালজয়ী সেই হেতু স্বরচিত কাব্যের বাঙ্ময় রূপ সম্পর্কে কবিকে সতর্ক, সচেতন ও যত্নশীল হতেই হয়। কোথায় কোন্ শব্দটি খাটবে, কোথায় কোন্ অর্থটি ঈপ্সিত, কোন্ অর্থে কোন্ শব্দের ব্যবহার সংগত, কোথায় কোন্ শব্দ প্রয়োজন সিদ্ধ হতে পারবে না—এসব বিষয়ে কবি যদি সাবধান না হন, তবে কাব্যপুরুষের শরীর ক্ষতিগ্রস্ত ও বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। যদি কবির শব্দচয়ন ও অর্থপ্রয়োগ ঠিকমতো না হয় তবে কবিকর্মের যাথার্থ নষ্ট হয়ে যায়’। (জীবেন্দ্র সিংহরায় প্রণীত কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থের শব্দার্থতত্ত্ব অধ্যায় )
বর্তমান সংখ্যা ‘কবিতার এক পাতা’র বিশেষত্ব এই—
দীর্ঘদিন যাঁরা কাব্যচর্চার সঙ্গে আছেন, তাঁদের সঙ্গে সম্ভাবনাময় নতুন কবির কবিতাও এক পাতায় রেখে পড়া। সাতজন কবির কবিতায় সাজানো ‘কবিতার এক পাতা’ জুলাই সংখ্যায় আপনাদেরকে সাদর আমন্ত্রণ।
আপনাদের প্রতি আমাদের সমনোযোগ, সপ্রাণ ভালোবাসা—ফারুক ফয়সল

কোলাজ
বদিউজ্জামান নাসিম

১.
হে সুখ, স্বর্গীয় মিতামহ
হে দুঃখ, প্রতিদিন পোড়াদহ !

২.
এ কেমন যৌবন দিন
অর্ধনমিত পতাকা মলিন !

৩.
তোমাদের ঘরে যত ঠাঁই, তাই
কত চিহ্ন, ক্ষতচিহ্ন রেখে যাই !

৪.
তুমি কার, আমি কার
একা একা একাকার!

যাব কতদূরে
হোসাইন কবির

বীভৎস রাতের প্রহরে
বিবিধ বিবেচনায়
পুরোনো দরজা কপাট হা হয়ে ডাকে
কোন সে গন্তব্যে কতটা দূরের!
তবু মুমূর্ষু নির্জনে কামুক খোলসে
উড়ন্ত রোদ্দুরে পড়ন্ত বিকেলে শিশির-সাম্পানে
জলের শরীর ভাঙে সবুজে অরণ্যে
ডুবে যায়
ডুবে যাই
প্রলম্বিত স্মৃতি-বিস্মৃতির জলারণ্যে
মুখোমুখি তার
কথা হয় জ্যামিতিক ভঙ্গিমায়
ধাবমান সময়ে
টানেলে
চলন্ত সড়কে
করোটিতে বয়সের ক্ষত
তবু পাথরে সবুজে ঢেউ খেলে যায়
আকাঙ্ক্ষার প্রস্তরিত
ফসিল বাসনায়
যাব কতদূরে!
যাব কোন সুদূরের
সময়স্রোতের আকাশগঙ্গায়!
আহা আত্মপরিচয়হীন অচেনা অবয়বের
অনুবাদ অন্ধ অনুকরণ আর কতকাল!
আঁচলের শস্যবীজে
শিশুরা দেবে না হামাগুড়ি
গোলাঘরে শস্যহীন মাঠে
নানাবিধ অবয়বে আর
তবু যেতে হবে আমাদের
ধাবমান দূরের আলোয় কিংবা তুমুল আঁধারে

কালঘুম
তুষার গায়েন

কত পথ ঘুরে সে এসেছে তারাজ্বলা আকাশের নিচে
যতটা অগম্যপথ সে অতিক্রম করে নিতে জানে
যখন নিঃসাড় দেহ ঝুর ঝুর ঘুমে ভেঙে পড়ে
তবু যেতে হয় আরও কিছু দূর–
যখন পেছনে কিছু নেই, অজানা সম্মুখে
নিচু হয়ে এসেছে পাহাড়, শিলার গভীরে কেটে
কল কল স্রোতস্বিনী প্রাণস্পর্শে জাগিয়ে তুলেছে
দুধারে সবুজ কিছু ঘাস, স্মৃতিবাহী মায়াবী বাতাস
জড়াই চোখের পাতা প্রগাঢ় আঠায়, নিশ্চেতনা...
মৃত্যুর অধিক ঘুম, ততোধিক ঘুমায় বেহালা পাশে–
জীবিকার অন্তিম সম্বল; তখন ক্ষুধার্ত সিংহ আসে
ঝুঁকে পড়ে শুঁকে দেখে প্রখর নাসিকা তার, ভাবে
এই মানুষ নিশ্চিত মৃত, আহারোপযোগী নয় আর!

পঠিত দুর্গের ভেতর
ফারহানা ইলিয়াস তুলি

যে ছায়াগুলো নিয়ে জীবন খেলা করে, তাকে
বলতে পারো ইতিহাস,
যে মাটিতে আদিম কাল থেকে জমা হয়ে থাকে
পাথর–তাকে বলতে পারো ভূগোল।
কিংবা এই যে গোলপাতার ছাউনিতে বসবাসী
মানুষ, যারা ইতিহাস অথবা ভূগোল কিছুই
পড়েনি–তাদের বলতে পারো নৃ-গোষ্ঠী।
.
পঠিত দুর্গের ভেতর যে মজ্জা অপেক্ষায় থাকে
আলিঙ্গনের, তাকে প্রেম কিংবা পরম যা-ই
বলো না কেন,
প্রাণের সান্নিধ্য পেলে একান্তই জলের উষ্ণতায়
সেই পরমই একদিন কাছে-দূরে আলো ছড়িয়ে যায়!

শূন্য
মুস্তাফিজ রহমান

শূন্য একটি মতবাদ, আদর্শ এবং দর্শন
শূন্য একটি নির্ভেজাল অহংকার
শূন্য একটি যথার্থ দুর্ঘটনা
একটি অযাচিত বিশ্লেষণ
একটি প্রাণহীন আকার
একটি অবধারিত মধ্যমপন্থা
শূন্য জগৎ সংসারের নয়
শূন্য সময়ের সাথে পাল্লা দেয় অজান্তে
শূন্য অশান্ত নদীর এপার ও ওপার
জাগতিক স্বপ্নসমূহের সফল উপস্থিতি
একটা গোটা আকাশের আশ্চর্য ব্যর্থতা
বিষাদ সুরের অর্থহীন ভেসে বেড়ানো
বিরাজমান
অপেক্ষা
শূন্য


বলে যে কুমার
স্বপ্ন কুমার

অনেক ওপরে উঠে যারা একদিন
তাদেরও নামতে হয় শেষতক নিচে
ছায়া কি সর্বদা আর চলে পিছে পিছে
কত পাড় ভেঙে নদী-গর্ভেই বিলীন...
আবারও নতুন পাড়ে গড়ে বসতি
আশাতে বুক বাঁধেন পুরোনো মানুষ
আবারও নদী তার বদলায় গতি
মানুষ নিয়ত দেয় নিয়তির দোষ
কার দোষ কতটুকু কার কত গুণ
ভুলে যাও সে হিসাব যদি ভালোবাসো
কার চোখে জল কার বুকেতে আগুন
সব ভুলে গিয়ে শুধু প্রাণ খুলে হাসো
হাসলে হৃদয় খোলে জানা নেই কার
হাসিতে লুকিয়ে রাখো দুঃখের পাহাড়


অনেক দিন পর
রুদ্রশংকর

আজ অনেক দিন পর বিষণ্ন বৃষ্টিতে ভিজলাম।
সম্পূর্ণ একা এক স্মৃতির চাবুকে
তোর্ষা নদীতে ভেসে গেছে যে ভালোবাসা,
হাত বাড়াতে তাকে আজ মুঠো ভরে মনে পড়ল।
আমার গৃহপালিত জীবনের সমস্ত অভাবী অক্ষরগুলো
এভাবেই মাঝেমধ্যে নেচে ওঠে,
আমার না-ঘুমোনো চোখে কুয়াশার মতো জমা হয় প্রেম।
অতটুকুই ধরা আছে আমাদের লবণাক্ত জল
অতটুকুই শান্তি আনে চৈতন্যের চঞ্চল দূরত্ব।