হনু মিয়ার দর্পচূর্ণ

ইংরেজিতে ‘রিভেঞ্জ অব নেচার’ বলে একটা কথা আছে। মানুষ তার মন্দ কাজের শাস্তি কোনো না কোনোভাবে পেয়েই যায়। আগে হোক আর পরে হোক, শাস্তি সে পাবেই। মানুষ ভুলে গেলেও প্রকৃতি কিছুই ভোলে না এবং প্রকৃতি ক্ষমাও করে না। আমেরিকায় নতুন যারা আসে, তাদের মধ্যে গ্রাম থেকে আসা অধিকাংশ মানুষ প্রথম প্রথম খুব ভাব নিয়ে চলে। তাদের ভাব দেখলে মনে হবে, এরা কোনো বিত্তশালী বা প্রতাপশালী রাজা কিংবা জমিদারদের বংশধর। বাংলাদেশে বিশাল সম্পত্তি ও শত শত দাসী-গোলাম রেখে আমেরিকায় এসেছে। এতে তাদের আফসোসের শেষ নেই। আমেরিকার রাস্তায় যখন হাঁটবে, যেন হাওয়ার ওপরে ভেসে ভেসে হাঁটছে। কাউকে দেখলেই খেজুরে আলাপ জুড়ে দেবে। তবে কিছুদিন যাওয়ার পর সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়। আমি এদের ‘হনু মিয়া’ বলেই সম্বোধন করি। এমনই একজন হনু মিয়ার গল্প বলছি আজ।
অনেক বছর আগের কথা। আমরা তখন একটা আটতলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাসিন্দা। এই ভবনের তিনটি পরিবার ছাড়া বাকি সবাই বাংলাদেশি। প্রবাসে বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যেন আত্মার আত্মীয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কারও না কারও বাসায় গেট-টুগেদার পার্টি থাকবেই। এটা আমাদের এখানে একটা রেওয়াজ বলা যায়। যা হোক, আমাদের ভবনের তৃতীয়তলায় এক বিধবা আপু ছিলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে দু সন্তান নিয়ে এখানে বসবাস করছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন খুব নম্র ও ভদ্র। ভবনের সবাই তাঁকে একটু সমীহ করে চলতেন। তাঁর ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। দেশ থেকে ফিরে এসে আপু সবাইকে বড় মুখ করে জানালেন, তাঁর বর খুব ভালো মনের একজন মানুষ। সবার কাছে দোয়া চাইলেন, তিনি যেন তাঁর নতুন বরকে যত দ্রুত সম্ভব আমেরিকা নিয়ে এসে সুখে সংসার করতে পারেন। অবশেষে আপুর নতুন বর মানে আমাদের নতুন ‘দুলা মিয়া’ আমেরিকায় এলেন। তখন বাস্তবে আমরা দেখতে পেলাম, আপুর নতুন বর ছিলেন একজন ‘নম্বর ওয়ান হনু মিয়া’।
‘হনু মিয়া’ ছিলেন সাংঘাতিক রকম দাম্ভিক মানুষ। নিজেকে মহাজ্ঞানী ও বাকি সবাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে চলেন। আমাদের সাপ্তাহিক গেট-টুগেদার পার্টিতে প্রথমবার এসেই নিজেকে ‘রায় বাহাদুর’ হিসেবে জাহির করলেন। তাঁর কথা বলার ভাবে মনে হচ্ছিল, তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ দশ প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিদের একজন। তিনি অতি উচ্চ শিক্ষিত, আর আমেরিকায় কোনো একটা নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করবেন।
আর আমাদের বিভিন্নভাবে হেয় করে কথা বলে নিজেকে এই সোসাইটির উচ্চ পর্যায়ের সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছিলেন তিনি। আমরা আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম দিনেই তাঁর কোনো কথার জবার দিইনি। সবাই চুপচাপ তাঁর আচরণ হজম করছিলাম। তবে এই ‘রায় বাহাদুর হনু মিয়ার’ আসল রূপ প্রকাশ পেতে বেশি দিন লাগেনি।
একদিন রাতে হনু মিয়া নিশ্চিন্তে নাক ডেকে বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। পাশে তাঁর ঘুমন্ত স্ত্রী, মানে আপু আচানক ধুপধাপ হাউমাউ শব্দে জেগে উঠে দেখেন, তাঁর হনু মিয়া ৯০ বছরের বুড়োদের মতো শরীর ও গলার স্বরে চিৎকার করার চেষ্টা করছেন ‘হু ইজ দিস...হু ইজ দিস...’ বলে। আপু সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন তাঁর বর সম্পূর্ণ উলঙ্গ। আপু বেচারি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে, ‘ব্যাপার কী, কী হয়েছে’, জিজ্ঞেস করতে যাবেন, সেই মুহূর্তে দিগম্বর অবস্থায় হনু মিয়া দরজা খুলে বাইরে চোঁ-চোঁ দৌড়। আপু পড়ি কি মরি বিছানা থেকে উঠে দরজার বাইরে গিয়ে দেখেন, তাঁর হনু মিয়া প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজায় ছোটাছুটি করছেন আর ধুমসে দু হাত দিয়ে বাড়ি মেরে চিৎকার করছেন ‘হেল্প, হেল্প’ বলে। রাত তখন আনুমানিক সাড়ে তিনটা বা চারটা হবে। এত রাতে এমন অস্বাভাবিক ব্যাপার; সবাই কম-বেশি আতঙ্কিত।
ফ্ল্যাটের দু-একজন সাহসী পুরুষ হাতের কাছে যা পেয়েছে, তা-ই নিয়ে বের হলেন ইতিমধ্যে। তাদের মধ্যে দু-একজন আবার ৯১১-এ কল দিয়ে দিয়েছে। ততক্ষণে এক-দুই করে আশপাশের সবাই জেগে উঠেছে। এর মধ্যে আপু দৌড়ে ঘর থেকে একটা লুঙ্গি এনে তাঁর বরের পেছনে সমানতালে ছুটতে শুরু করেছেন। ভবনের সবাই দেখার আগেই যদি কোনোমতে হনু মিয়াকে পরানো যায় লুঙ্গিখানা। কিন্তু বেচারি আপুকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসার কোনো সুযোগই দিচ্ছে না হনু মিয়া। বিভিন্ন ফ্ল্যাটের পুরুষদের সবাই বের হয়েছেন। প্রতিটি দরজার পেছনে তখন গুঁতোগুঁতি চলছে; তাদের বউ, ছাওপাওদের বাইরে আসার বিষম তাড়া। হচ্ছেটা কী, তা একবার চক্ষু মেলিয়া দেখবার স্বাদ।
সবাই লজ্জিত নয়নে দেখছে, হনু মিয়া যে দিগম্বর হয়ে ঘণ্টা নাড়িয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। একজন প্রতিবেশী ভাই ছোঁ মেরে হনুমিয়ার স্ত্রীর হাত থেকে লুঙ্গি নিলেন এবং আরেক প্রতিবেশী ভাই জাপটে ধরে হনু মিয়াকে কোনোমতে লুঙ্গি পরিয়ে দিয়েছেন। তারপর তাঁদের সহযোগিতায় হনু মিয়াকে কিছুটা ধাতস্থ করা গেল। এরপর হনু মিয়া ও আপুকে সবাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, ঘটনা কী?’ এই মুহূর্তেই পুলিশও এসে হাজির। তাদেরও একই জিজ্ঞাসা, ‘কী হলো রে?’ তখন হনুর থলে থেকে যা বের হলো, তা শুনে আমেরিকান পুলিশদের হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা। হবে নাই বা কেন? আমেরিকান পুলিশদের কাছে জাতি ভাইয়ের এ কাণ্ডে ইজ্জতের ‘ত্যানা ত্যানা’ অবস্থা করে ছেড়েছে হনু মিয়া।
এবার মূল ঘটনায় আসি। আমেরিকায় শীতের সময় প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি ঘরে হিটিং সিস্টেম আছে। রুমের টেম্পারেচার অনুযায়ী হিট চলে বন্ধ হয়। বন্ধ হওয়ার পর যখন আবার চালু হয়, তখন মাঝে মাঝে বিকট ঘটাং ঘটাং শব্দ হয়। বিশেষ করে পুরোনো অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের হিট চালু হওয়ার আগে মাঝেমধ্যে এমন ভীষণ শব্দ করে। আটতলা ভবনের তৃতীয়তলায় হনু মিয়া থাকেন। তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের জানালার নিচেই হিটিংয়ের ব্যবস্থা। সেই জানালার সঙ্গেই জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি। হিট চালু হওয়ার সময় মাঝেমধ্যে বিকট শব্দ হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে হনু মিয়ার ধারণা ছিল না।
সেদিন রাতে ঘুমের ঘোরে এ আওয়াজ তাঁর কানে যেই না গেছে, তিনি ভয়ে দিশেহারা হয়ে এক্কেবারে বিদিশা। তাঁর ধারণা হয়েছে, জানালা ভেঙে ডাকাত ঘরের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। আর তাতেই তাঁর দিগম্বর হয়ে এই এলাহি কাণ্ড ঘটিয়ে আমাদের লক্ষ্মী আপুর এত দিনের ইজ্জত একদিনেই পাংচার করে দিলেন। সে সঙ্গে আমেরিকান পুলিশের সামনে বাঙালি জাতিরও মান গেল। এই ঘটনার পর হনু মিয়ার সব দর্প একেবারে চূর্ণ হলো। এখনো নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালির লোকগাথায় হনু মিয়ার দর্পচূর্ণের গল্পটি হাসির রসদ হিসেবে আসে।