নাট্যচর্চায় বিদেশি নাটকের প্রভাব

স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে এক বিপ্লব ঘটে গেছে—এ কথা সবারই জানা। এ বিপ্লবের ফসল হিসেবে আমরা পাই অগণিত মঞ্চ সফল নাট্যপ্রযোজনা, নাট্যকর্মী, দর্শক ও নাটকের মঞ্চ। এসব অর্জনের গর্বে আমাদের অহংকার জাগে। যদিও নাটকে পেশাদারি এখনো অর্জিত হয়নি তবুও যেটুকু হয়েছে তাতে আমরা আশায় বুক বাঁধি। একদিন নিশ্চয়ই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে, মঞ্চে সম্পূর্ণ পেশাদার নাট্যচর্চা হবে।
তবে একটি ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সংশয় দেখা যায়, তা হলো নাট্যরচনা। এখনো খুব বেশি আশাব্যঞ্জক মৌলিক নাটক রচিত হয়নি। মৌলিক নাটকের পাশে বিদেশি নাটকের আধিক্য আমাদের ভাবিত করে। বিদেশি নাটক আমরা কেন করছি? বিদেশি নাটক কি আমাদের নাট্যচর্চার বিকাশকে ব্যাহত করছে?
বিদেশি নাটক প্রধানত দুভাবে আমাদের মঞ্চে দেখি। একটি অনুবাদ বা ভাষান্তর, অন্যটি রূপান্তর। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল নাটকের সব উপাদান ঠিক রেখে শুধু সংলাপগুলো বাংলায় রূপান্তর করা হয়। এতে মূল বিদেশের প্রেক্ষাপটে বিদেশি চরিত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘটনাপ্রবাহ উপভোগ করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে মূল নাটকের আস্বাদ পেতে হলে ওই নাটক রচনার সামাজিক প্রেক্ষাপট ও সময়কাল সম্পর্কে দর্শকদের আগে থেকেই জ্ঞান থাকতে হবে। অনুবাদের সফলতা নির্ভর করে অনুবাদকের ভাষা জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর। প্রত্যেক ভাষারই নিজস্ব রীতি ও শব্দ ভান্ডার রয়েছে। তাই এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদ করলে মূল লেখনীর রস কখনোই পাওয়া যাবে না। তাই অনুবাদ হলেও মূল রসকে বাংলা ভাষায় নতুন রূপে উপস্থাপন করতে হবে। সে জন্য অনুবাদককে দুই ভাষাতেই সমান পারদর্শী হতে হয়। বিশেষ করে কাব্য নাটক হলে তো কথাই নেই, নতুন করে বাংলায় কবিতা লিখতে হবে। এ কারণেই অনেক অনুবাদ নাটকে দর্শক বিরক্তি বোধ করে, যদিও মূল নাটকটি অনেক উন্নত মানের। নাটক অনুবাদ তাই সবার সাধ্য নয়। এমনকি যারা মৌলিক নাটক রচনায় পারঙ্গম তাঁদের অনেকের পক্ষেও সার্থক অনুবাদ নাটক নির্মাণ সম্ভব নয়।
এবার আসি রূপান্তর নাটক প্রসঙ্গে। মূল নাটকের বিষয়বস্তু, ঘটনাপ্রবাহ ও বক্তব্য ধারণ করে বাংলা ভাষায় নতুন করে নাটক রচনা। এ নাটকের পাত্র-পাত্রী হবে বাঙালি, প্রেক্ষাপট হবে বাংলাদেশের সমাজ। নাটক দেখে দর্শক বুঝতে পারবে না এটি বিদেশি নাটক, যদি না তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। দর্শকের বিবেচনায় অনুবাদ নাটকের চেয়ে রূপান্তর নাটক বেশি আকর্ষণীয়, কারণ এ নাটক উপভোগ করতে কষ্ট হয় না। চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহ তাদের অতি পরিচিত। তবে মূল নাটকের রস অনেক ক্ষেত্রেই রূপান্তর নাটকে পাওয়া যায় না। শেক্‌সপিয়ারের রূপান্তরিত কোনো নাটক থেকে নাট্য শৈলী, রস, রূপকের ব্যবহার, মানসিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করা কঠিন। অবশ্য বিষয়টি নির্ভর করে রূপান্তরকারীর দক্ষতার ওপর। সার্থক রূপান্তরিত নাটকে দর্শক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাটক উপভোগ করার পাশাপাশি মূল নাটকের আস্বাদও পেতে পারে। রূপান্তরকারীকেও দুই ভাষাতেই যেমন দক্ষ হতে হয় তেমনি ভীষণভাবে সৃজনশীল হতে হয়। কারণ মূল নাটকের রস ও বক্তব্য ধারণ করতে পারে এমন বিষয়, গল্প ও চরিত্র নির্মাণ করতে হয় একেবারে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে। ফলে একই নাটকের বিভিন্ন রূপান্তর অনেক সময়ই সম্পূর্ণ ভিন্ন হয় রূপান্তরকারীর সৃজনশীলতার ভিন্নতায়। এখানে কোনটি সবচেয়ে বেশি সার্থক তা নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। কারণ ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তর বিভিন্ন দর্শকের মনে পৃথক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ থেকেই আবার জন্ম নেয় অনুবাদ ও রূপান্তরের মাঝে দ্বন্দ্ব।
কারও মতে, বিদেশি নাটক অনুবাদ ছাড়া অভিনয় করা উচিৎ নয়, রূপান্তর শুধু নাটকের বিকৃতি ঘটায়। অন্য পক্ষের দাবি, নাটকের অনুবাদ কখনো সার্থক ও দর্শক নন্দিত হতে পারে না। রূপান্তরের মাধ্যমেই একমাত্র একটি বিদেশি নাটককে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব। তবে এ বিতর্কের কোনো উপসংহার নেই; অনুবাদক বা রূপান্তরকারীর যোগ্যতা এবং একই সঙ্গে দর্শকের মেধামান উন্নত হলে যেকোনো নাটকই সার্থক হতে পারে।
অনুবাদ ও রূপান্তর ছাড়াও বিদেশি নাটকের ক্ষেত্রে আরও একটি ধারা রয়েছে, যদিও ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়। তা হলো, ‘বিদেশি নাটক অবলম্বনে’ দেশি নাটক রচনা। এটি রূপান্তরের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে। মূল নাটকের বক্তব্য ও বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে বাংলায় সম্পূর্ণ নতুন করে নাটক নির্মাণ। এখানে চরিত্র ও গল্প মূল নাটক থেকে একেবারে পৃথক হতে পারে। এ নাটককে মূল বিদেশি নাটকের সঙ্গে তুলনা করে এর সার্থকতা বিচার করা ঠিক নয়। নাট্যকারের সৃজনীশক্তি ও নাট্য শৈলীর একমাত্র বিচার করা যেতে পারে। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে যান, রচনা করেন ‘বিদেশি নাটক দ্বারা অনুপ্রাণিত’ নাটক। এ ধরনের নাটক কোনোক্রমেই মূল বিদেশি নাটকের সঙ্গে তুলনীয় নয়, অনেক সময় বিদেশি নাটকের উল্লেখও থাকে না। সাহিত্যের বিচারে এরূপ ধারার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।
বিদেশি নাটকের প্রকারভেদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দেওয়া হলো। এবার মূল আলোচনায় আসি, কেন বিদেশি নাটক মঞ্চস্থ করি। এর কারণ বোধ করি বহুবিধ। প্রথমত, বিদেশি যেসব নাটক আমরা নির্বাচন করি সেগুলোর মান ও জনপ্রিয়তা পরীক্ষিত। শেক্‌সপিয়ার বা মলিয়েরের কোনো নাটক হাতে নিলে নাটকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হয় না, ভাবনা শুধু প্রয়োগ নিয়ে। যারা নাট্যাঙ্গনে নতুন এসেছেন বা যাদের আত্মবিশ্বাস কম তাঁরা বেশি ঝুঁকে পড়েন বিদেশি নাটকের প্রতি। নাটকও নতুন, দলও নতুন, এমন নাট্যপ্রযোজনা দর্শকপ্রিয়তা অর্জনে খুব বেগ পেতে হয়। বিশেষত প্রয়োগে যদি চমক না থাকে। আবার অনেকে নাটকের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এমন অহংবোধে ভোগে যে তখন অভিনয় বা নির্দেশনার জন্য দেশীয় কোনো নাটক পছন্দ হয় না। এমনকি তাঁদের নাট্যালোচনায়ও দেশীয় নাটকের কোনো স্থান থাকে না। যাই হোক, বিদেশি নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে এগুলো প্রধান কারণ নয়। অনেক প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল ও নাট্যজন বিদেশি নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় ‘ভালো’-র সন্ধান করা। শেক্‌সপিয়ার, ব্রেশট, মলিয়ের, ইবসেন, গোগল প্রমুখের নাটক চর্চা না করে তো নাট্য সাধনা পূর্ণ হবে না। নাটকের পাঠ শুরু করতে হবে প্রাচীন গ্রিক থিয়েটার থেকে। এরপর বিশ্বের সব দেশের ঐতিহ্যপূর্ণ সমৃদ্ধ নাটক ও ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে। নাট্যচর্চায় কূপমণ্ডূকতার স্থান নেই। নাট্যকর্মীদের যেমন, দর্শকদেরও মেধা ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করতে এবং নাট্যরস আস্বাদনে বিদেশি নাটকের প্রয়োজনীয়তা অসীম।
বিদেশি নাটকের অপরিহার্যতার আর একটি কারণ দেশীয় মৌলিক নাটকের অপর্যাপ্ততা। স্বাধীনতার আগে মুনীর চৌধুরী ছাড়া আর কারও কাছ থেকে তেমন আধুনিক নাটক পাওয়া যায়নি। অনুবাদ ও রূপান্তরের ক্ষেত্রেও মুনীর চৌধুরী ছিলেন পথিকৃৎ। স্বাধীনতা উত্তরকালে যখন নাট্যচর্চার জোয়ার শুরু হলো তখন চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত মৌলিক নাটক রচিত হয়নি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই নাট্যদলগুলো বিদেশি নাটকের দ্বারস্থ হয়। এমনকি নাট্যকর্মীদের অনেকেই নাটক অনুবাদ বা রূপান্তরে আত্মনিয়োগ করে সে সময়ের চাহিদা মেটাতে। ধীরে ধীরে কয়েকজন মৌলিক নাট্যকার পেলেও নাটকের সংখ্যা ও গুণগত মান বিদেশি নাটককে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই বিদেশি নাটকের প্রতি নাট্যকর্মী ও দর্শকের ঝোঁক আজও বিদ্যমান।