আমি কেউ না

গ্রীষ্মের সোনালি রোদের রোববার সকাল। স্থান আমেরিকার শিকাগো শহরের ডেভন অ্যাভিনিউ। এই এলাকাটি ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের জনপ্রিয় শপিং এলাকা। বিশেষ করে দেশীয় খাবারদাবার, কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি ইত্যাদি। মসজিদ, মন্দিরের সংখ্যাও কম নয়। সেদিন আটলান্টিকের অন্যপ্রান্তে লন্ডনে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। স্বভাবতই দোকানপাটে সুনসান নীরবতা। সবাই ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত।
ডেভন অ্যাভিনিউয়ের তাহুরা রেস্টুরেন্টে সবে মাত্র খুলেছে। এই হোটেল উইকেন্ডে হালুয়া পুরি নাশতার জন্য বিখ্যাত। আমি পরিবারসহ সকাল সকালেই দোকানের সামনে গিয়ে হাজির। সবেমাত্র ভিড় জমা শুরু হয়েছে। যে টেবিলে বসলাম সেটার অন্যপাশে ব্যস্ততাহীন ফুটপাত। মাঝখানে কাচের দেয়াল। নাশতার চা পর্ব যখন চলছিল তখন আমার চোখ গিয়ে আটকাল কাচের অন্যপাশে এক ফেরিওয়ালার দিকে। আইসক্রিমের দুই চাকার ভ্যান নিয়ে ফেরিওয়ালা আমার তিন বছরের মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ক্ষণেক্ষণে সাবানের বেলুন বের করে আকাশের দিকে ছুড়ছে। মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। অসংখ্য সাবানের বেলুন কাচে ঘষা খেয়ে ক্ষণেক্ষণে বিস্ফোরিত হচ্ছে। ভাগ্যবান কয়েকটা আবার আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে।
আমার মেয়ে সেটা দেখামাত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আমি তার মনোযোগ অন্যত্র সরাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হলাম। উদ্দেশ্য, ফেরিওয়ালা থেকে দৃষ্টি অন্যত্র নেওয়া। বিক্রেতাও নাছোড়বান্দা। সে বেলুন ছোড়া বন্ধ করে এবার রঙিন চরকি বা পাখার মতো কিছু একটা বের করল। এভাবেই মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। নাশতা শেষ করে ফুটপাতে এলাম। ফেরিওয়ালা একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে। তার দুই হাতে দুই ধরনের খেলনা। আমি অন্যদিকে যেতে চেষ্টা করলাম। মেয়ে আমার হাত টান দিয়ে ইশার করল। বড়শিতে মাছ লাগার মতো করে ফেরিওয়ালার দিকে টানতে লাগল।
-ওনলি ফাইভ ডলার? বাই দিস প্লিজ—ফেরিওয়ালার আকুতি।
বলে রাখি। আমি এই শহরে বেড়াতে গিয়েছি এক রাত একদিনের জন্য। লন্ডনের পথে যাত্রা বিরতি। পরের দিন দুপুরে ফ্লাইট। ব্যাগে জায়গা নেই। তা ছাড়া সাবানেই ফেনা বা পানি জাতীয় জিনিস হাতের ব্যাগে নিয়ে ফ্লাই করা নিষিদ্ধ।
আমার স্ত্রী ইশারা দিল, লোকটিকে কিছু বকশিশ দিয়ে দিতে। বেচারা এতক্ষণ ধরে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছে। দিনের মাত্র শুরু। হয়তো এখনো পর্যন্ত কোনো বিক্রি হয়নি। কিন্তু সে কেন বিক্রি ছাড়া শুধু শুধু বকশিশ নেবে? আমার বলতেও তো খারাপ লাগবে।
কেনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম, দাম কত?
-ওয়ান ফর টেন ডলার, টু ফর ফিফটিন
-একটা হলেই চলবে। আমি এই শহরের নই। অন্য দেশে যাচ্ছি। তা ছাড়া ব্যাগে এগুলো নিয়ে ফ্লাই করতে পারব না।
- পিপল টেক ইট ব্যাক হোম টু।
আমি ২০ ডলারের নোট দিয়ে বললাম বাকিটা ফেরত দিতে হবে না।
ফেরিওয়ালা তার ব্যাগ থেকে আরও পাঁচ কি ছয়টি ললিপপ বের করে মেয়ের হাতে দিল।
কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। যদি কিছু মনে না করেন, অরিজিন্যালি আপনি কোন দেশের?
-বাংলাদেশ। আই এম লিভিং হেয়ার ফর টুয়েন্টি ওয়ান ইয়ার।
–ও তাই নাকি? পরবর্তী আলোচনা বাংলাতেই হলো।
-বাংলাদেশের কোথায়?
-ভোলায়।
-আগে অন্য কোন স্টেটে ছিলেন?
-পেনসিলভানিয়া আর মিশিগানে।
এভাবেই গল্প বাড়তে লাগল।
লোকটির নামধাম, দেশে গ্রামের বাড়ি, শিকাগোতে কোথায় থাকে, অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া থেকে শুরু করে সবকিছুরই বর্ণনা দিল। গলায় ঝোলানো স্ট্রিট সহকারী লাইসেন্সও দেখাতে ভুল করল না। আলাপচারিতা শেষে আমি গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। লোকটিও বিদায় নিয়ে স্ট্রিটের অন্যদিকে হাঁটা শুরু করল। সাবানের বেলুন উড়াতে উড়াতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরদিন সকাল। শিকাগো মায়ের এইটপোর্টে রেন্ট করা গাড়ি ফেরত দিয়ে ফ্লাইটের গেটে গিয়ে হাজির হলাম। ফ্লাইট অন টাইম কিন্তু তখনো তিন ঘণ্টা বাকি। আমার গন্তব্য লন্ডনের হিথ্রো। নিউইয়র্কে আবার প্লেন পরিবর্তনসহ ছয় ঘণ্টার বিরতি। সময় কাটানোর জন্য এদিক-ওদিক মেয়েকে নিয়ে হাঁটছি। বাচ্চাদের নিয়ে উড়োজাহাজ যাত্রায় আমি কখনো তাদের প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে দিই না। উদ্দেশ্য প্লেনে ওঠার পর যাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিশেষ করে দীর্ঘ প্লেন ভ্রমণে।
-প্যাসেঞ্জার মিস্টার সাইয়েদ (সৈয়দকে আমেরিকানরা এভাবেই ডাকে এবং আমিও শুনতে অভ্যস্ত)। প্লিজ রিপোর্ট টু ইউনাইটেড এয়ারলাইনস কাউন্টার ইমিডিয়েটলি।
লাউড স্পিকারে হঠাৎ নিজের নাম শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে গেলাম। নির্ঘাত কোন বিরাট ঝামেলা অপেক্ষা করছে। হোটেল ছেড়ে, গাড়ি ফেরত দিয়ে মাত্র এয়ারপোর্টে আসলাম। ভাগ্যে কী লেখা আছে খোদা জানে।
আবারও আমার নাম ডাকল।
দুরুদুরু বুক নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে হাজির হলাম।
-তুমি কি প্যাসেঞ্জার সাইয়েদ?
-হ্যাঁ,
-আমাদের নিউইয়র্কগামী ফ্লাইট ওভার বুকড। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম,
-আমার সঙ্গে দুই বাচ্চা। প্লিজ, ফ্লাইট সংক্রান্ত কোনো বাজে সংবাদ দিয়ো না।
-তোমার নিউইয়র্কের ফ্লাইট বাদ দিয়ে কি এখান থেকে সরাসরি লন্ডনের ফ্লাইট দিতে পারি? আগের ফ্লাইটের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও এক ঘণ্টা আগে লন্ডনে পৌঁছাবে? যদি রাজি থাক, তাহলে সব পাসপোর্ট দাও। আমি সব ব্যবস্থা করছি।
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এ রকম লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা মানে সুইসাইড করা। নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে লন্ডন ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোনো প্ল্যান ছিল না।
-অবশ্যই রাজি। কিন্তু আমি তো লাগেজ ড্রপ করে দিয়েছি।
-কোনো অসুবিধা নেই। আমি লাগেজ নামানোর জন্য বলে দিচ্ছি।
এয়ারলাইনসের নারী কর্মীটি ওয়ারলেসে তৎক্ষণাৎ আমার লাগেজের বর্ণনা দিল। আসল চমকের জন্য আমি তখনো প্রস্তুত ছিলাম না। কাউন্টারের নারী বলে চলল—
-আর যেহেতু তোমার ফ্লাইট সময়সূচি আমরা পরিবর্তন করছি, সে জন্য প্রতি প্যাসেঞ্জারকে আমরা দুই হাজার ডলারের সমমান এয়ারলাইনস টিকিটের ফ্রি ভাউচার দেব।
-ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু প্রসিড?
-ঢোক গিলে বললাম, এর মানে কি?
-মানে হচ্ছে ইউনাইটেড এয়ারলাইনস আমেরিকা বা পৃথিবীর যেখানেই যায়, তুমি সেখানে ফ্লাই করতে পারবে এই ভাউচার ব্যবহার করে। প্রতি ভাউচার দুই হাজার ডলার সমমানের টিকিট, যেটা তুমি ফ্রি পাবে।
-আমরা তো বাচ্চাসহ চারজন প্যাসেঞ্জার। তার মানে আট হাজার ডলার সমান ফ্রি টিকিট।
-ঠিক তাই।
-এটার মধ্যে তো কোনো ক্যাচ বা ছলচাতুরী কিছু নেই তো?
-না। এইটা এয়ারলাইনসের পলিসি। তুমি চাইলে আমি এক্ষুনি ভাউচারসহ সবকিছু তৈরি করে দেব।
-প্লিজ, প্লিজ।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে ওই নারীকর্মী লন্ডনের বোর্ডিং পাস দিল প্রথমে। তারপর অনলাইন ভাউচার রেডি করে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ইমেইল করে দিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম।
শুধু তাই নয়। লন্ডনগামী বোর্ডিং পাসের সঙ্গে আমাদের চারজনের জন্য মোট আটটি ফুড ভাউচারও দিল। অর্থাৎ চারজনের দুইবেলা করে খাবারের জন্য দশ ডলার সমমূল্যের মোট আশি ডলার। সেগুলো শুধু মায়ের এয়ারপোর্টেই ব্যবহার করতে হবে এবং পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। আমরা যদিও ইতিমধ্যে খাবারের পর্ব শেষ করে ফেলেছি।
স্ত্রীকে বললাম, খাবারের সব ভাউচার তো ব্যবহার করা যাবে না। কারণ আমরা কেউ তো ক্ষুধার্ত নই। তা ছাড়া ফ্লাইটের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। সুতরাং ভালো হবে, যদি গরিব টাইপের কোন প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায়, তাকে দিয়ে দেওয়া। স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে চরম উৎসাহী হয়ে গরিব প্যাসেঞ্জার খুঁজতে গেল। আমি মেয়েকে নিয়ে প্লেনের গেটে অপেক্ষায়। বলে রাখা ভালো, ওই ভাউচারগুলো দিয়ে শুধু খাবার কেনা যাবে। অন্য কিছু কিনতে গেলে দোকানি নেবে না।
স্ত্রীকে গরিব প্যাসেঞ্জার শনাক্ত করার কিছু টিপসও দিলাম। এই যেমন, কালো আমেরিকান মহিলা হলে ভালো। সঙ্গে ছোট বাচ্চা থাকলে আরও ভালো। পুরুষ হলে চোখ লাল লাল। যাতে মনে হয়, সে এয়ারপোর্টে দীর্ঘ সময় ধরে আটকা পড়ে আছে। ক্লান্ত, ঘুমহীন কিংবা ক্ষুধার্ত কিন্তু পকেট খালি। হতে পারে ফ্লাইট মিস করে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষারত। মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ বের হলে না। পোশাক-আশাকে গরিবি ভাব থাকতে হবে। তবে যত গরিবই দেখতে হোক, হাতে আইফোন থাকলে ডিসকোয়ালিফাইড। গ্রহীতা পুরুষ, নারী, এক বা একাধিক হতে পারে। টার্গেট শনাক্ত করার পর কীভাবে ফ্রি ভাউচার দেওয়ার কথাটা উত্থাপন করবে, সে ব্যাপারেও স্ত্রীর সঙ্গে শলাপরামর্শ হলো। গরিব প্যাসেঞ্জার খোঁজার কাজ পেয়ে স্ত্রী খুব খুশি হলো।
মিনিট দশেক পর স্ত্রী ও ছেলে আইসক্রিম হাতে হাজির। মিশন কমপ্লিট। শর্ত মোতাবেক গরিব খুঁজে পেয়েছে এবং বিলিবন্টনও শেষ। তবে আটটি ভাউচারের পরিবর্তে সে সাতটি বিলিয়ে দিয়েছে। একটি দিয়ে নিজেদের জন্য আইসক্রিম নিয়েছে।
আমাদের লন্ডন যাত্রা শুরু হলো যথাসময়ে। প্লেন যখন আটলান্টিকের ওপর মেঘের দেশে সবাই তখন ঘুমের ঘোরে। আমি ঘুমাতে পারি না। পাহারাদারের মতো জেগে থাকি। অথচ পাহারা দেওয়ার মতো মূল্যবান কিছুই আশপাশে নেই। জেগে থেকেও আবার জেগে উঠি। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি। সময় কাটে না। মনে হয় জীবন কেন এত বড়। এ যাত্রার শেষ কোথায়? কোথায় যাই? কার কাছে যাই? কেন যাই? হাত বাড়িয়ে ওপরের কম্পার্টমেন্ট থেকে আমি পুরোনো ডায়েরি বের করি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাই। এলোমেলো সব অতীতের লেখা। এক জায়গায় গিয়ে আমার দৃষ্টি আটকায়। কবে, কোথায়, কেন যেন লিখেছিলাম জানি না।
আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। পৃথিবীর আরও লক্ষ–কোটি মানুষের মতো আমারও একটা জীবন। এই জীবনে আমারও সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব-অভিযোগ, পরিবার, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবকিছুই আছে। আমিও অনেকের কাছে প্রিয়, আবার অনেকের কাছে নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুক। আমিও কাউকে ভয় পাই। আবার আমিই হয়তো কারও ভয়ের কারণ। আমিও দিশেহারা হই, আবার এই আমিও কাউকে পথ দেখাই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কখনো পথ হারিয়ে ফেলি কিংবা অন্য পথে চলে যাই। আমি কারও অশ্রুজলের কারণ। কেউ আমাকে খুঁজে বেড়ায়, আমিও কাউকে খুঁজে ফিরি। এই খোঁজাখুঁজির মাঝে সাক্ষাৎ মিলে অনেক ঘটন-অঘটনের। আমি সযত্নে সেগুলো পকেটে ভরে নিই। আবার পথে নামি। সেই পথ মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে বন্ধুর, পিচ্ছিল, দুর্বোধ্য কিংবা ভয়ংকর। তবুও আমি হাঁটি, এগিয়ে যাই। কিছু একটা খুঁজে বেড়াই। এই খোঁজা কখনো শেষ হয় না, শেষ হওয়ার নয়। দিন শেষে যখন ঘুমাতে যাই, তখন প্রায়ই কেউ আমাকে ফিসফিস করে বলে, আপনি কে? সারা দিন কি খুঁজলেন, আর কিইবা পেলেন? আমি অন্ধকারে পকেট হাতড়ে বেড়াই। কিন্তু আমার শরীরে জামা-পকেট বলে কিছুই নেই। শুধুই অন্ধকার, গহিন অন্ধকারে পকেট খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। বারবার প্রশ্নবানে জর্জরিত হই, এই যে আপনি কে? আপনি কে? আমি চিৎকার দিয়ে বলি, আমি কেউ না, আমি আমি কেউ না, আমি কেউ না।