তিনি একজন রাজনীতিবিদ

‘আপনি একজন মাস্টার, আর উনি তো ভুসিমালের মহাজন! কত টাকাই বা আপনাদের আয়-ইনকাম, আমার কিন্তু এসবে পোষাবে না।’

‘তো, ভাইজান আপনার পেশাটা কি?’ রম্য হাসির ঝিলিক ওনার সিগারেট পোড়া কাল দুটো ঠোঁটের মাঝখানে, সিগারেটের সঙ্গে যে পান সুপারিরও ভালো একটা সুখ সুখ মহব্বত মুখ গহ্বরে বিরাজিত, সেটা ওনার দাঁতের ওপর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারা সিল ছাপ্পরগুলোই বুঝিয়ে দিচ্ছে!

ওনার এমন ঢং ভরা হাসি যেন আমাকে বিদ্রূপ করছিল, বোধ হয় এমন কিছু করেন, হয়তো এমন কোন কেওকারাডংয়ের চূড়ায় ওনার অবস্থান, যেখান থেকে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায়ীকে পিঁপড়ার মতো মনে হচ্ছে! মস্তিষ্কের ভেতরে আগ্রহের প্রচণ্ড মোচড় অনুভব করলাম, আর তর সইলোনা, মুখের ভেতর থেকে এক্সপ্রেস গতিতে বেরিয়ে এল ‘ভাই, আপনার পেশাটা কি!’

‘রাজনীতি’–দাম্ভিক উত্তর! মনে হল উত্তরটা দেওয়ার জন্য যেন ওনার ভেতরটাও কিলবিল করছিল। আড়চোখে এবার মনযোগ দিয়ে ওনার বাহ্যিক সুরতের পোস্ট মর্টেমটা করে নিলাম, ‘ও আচ্ছা, ভাইজান বোধ হয় বিরাট ব্যবসায়ী, দু–চারটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অনেক কর্মচারী, তারাই সেগুলো দেখভাল করে। সে জন্যই হয়তো নিজের অফুরান সময়টুকু রাজনীতিতে এসে জনসেবায় উৎসর্গ করছেন!

...মনু মহাজনের ছোট্ট টং দোকানে চায়ের কাপে আবেশ ভরা শেষ চুমুকটুকু দিতে দিতে আবারও ভেলকি মারা হাসি দিয়ে উনি হাঁটা শুরু করলেন। উনি হাঁটছেন আর হাস্যরসে ভরপুর সুরতখান ঘুরিয়ে আমার দিকে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন! মনে হল, আমি বোধ হয় পুরোপুরি হাস্যকর উপাদানে মোড়ানো কিছু বলেছি, অনেকটা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছি ওনার প্রস্থান পানে!

–‘ভাইজান কি ভাবেন?’ মনু মহাজনের কথায় আমার অন্য মনস্কতায় ছেদ পড়ল!

‘আমি জানি আপনি কি ভাবতেছেন, এই যে রাজনীতিবিদ ভাই চলে গেলেন, আপনি ওনার কথাই ভাবতেছেন!’

–‘জি, না, মানে হ্যাঁ!’
–‘উনি রাজনীতিবিদ, এটাই ওনার পরিচয়, এটাই ওনার কর্ম কিংবা বলতে পারেন অঘোষিত ধর্মও! আমার দোকানে যদি কোন খরচ করেন, সেটা হয়তো ওনার বউ পরিশোধ করবেন নতুবা আপনার মতো কেউ, যেমন আজকের চায়ের বিলটা আপনি দেবেন, ভদ্রতার খাতিরে হলেও দেবেন।’

–‘হুম, ঠিক আছে! কিন্তু বউ শোধ করবে মানে কি? উনি কোন কাজ–কাম করেন না?’

–‘উনি তো রাজনীতিবিদ, ভিলেজ পলিটিশিয়ান, ওনার নির্দিষ্ট কোন কাজ–কাম নাই। কত ব্যস্ত মানুষ, সবাই ওনাকে তাদের প্রয়োজনে ডাকে, কত কত জরুরি কাজ উনি করিয়ে দেন! বউ একটা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে বলেই তো রক্ষা।’

–আমি আমার মনের সঙ্গে এই ধরনের রাজনীতিবিদদের সোজাসাপটা হিসাবগুলো মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম! তখন থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই আগাছা পরগাছার মতো রাজনীতিবিদের ঘনঘটায় দেশটা যেন মুমূর্ষু, নিশ্বাস নিতে পারছে না। যারা নিজেকে নিজে চালাবার হিম্মত নেই, সেই পেরেশানিও নেই, নেই কোনো চিন্তা পরিকল্পনা; তারাই চায় সবার অবস্থা পরিবর্তন করতে, সবার পেরেশানি দূর করতে? কোন ব্যক্তি নিজে স্বাবলম্বী না হয়ে, যোগ্যতা সম্পন্ন না হয়ে রাজনীতি করলে, যখনই সে সুযোগ পাবে, নিজের অজান্তেই দেশের ক্ষতি করবে, সমাজের ক্ষতি করবে, পরিবারের ক্ষতি করবে, সর্বোপরি নিজের ক্ষতিটাও করবে।