আহম্মদ হোসেন বাবুর গুচ্ছ

বরেন্দ্রভূমির জন্য ভালোবাসা

চেনা রাস্তা, চেনা ঘর, চেনা মানুষ আজ সবই
সময়ের ব্যবধানে কেমন যেন অচেনা হয়ে যায় ।
যা দেখি সবই নতুন নয়নাভিরাম গাঢ় সবুজে ঢাকা
আত্রাইয়ের উর্বর পলিমাটি, পলকহীন হয়ে থাকি।
দৃষ্টি আটকে যায়, মুগ্ধ মন গেঁথে থাকে পাখ-পাখালির ডাকে
আমি সবুজের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে যাই সমুখে।

ইসমাইল স্যার কলেজে বায়োলজি পড়াতেন
প্রায় ত্রিশ বছর পর আজ দেখা হলো মুখোমুখি
অনেক কথার ফাঁকে স্যার জানতে চাইলেন—
আহম্মদ হোসেন বাবুকে আমি চিনি কি না !
কী বলব জানি না, বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক
স্যারের চোখে চোখ রেখে আমি তখন স্যারের
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্র খুঁজে ফিরছিলাম!
এতক্ষণ ধরে এত কাছে, এত কথা বলার পরও
স্যার আমাকে চিনতে পারলেন না !
সময়ের ব্যবধানে সবকিছু বড় জটিল সমীকরণ হয়ে যায় !
আমিও পারি না তেমন অনেককে চিনতে, বড় ভুল হয়ে যায় ।
বোকার মতো সরলতা নিয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে
তৃষিত আঁখি নিয়ে ত্রিশ বছর আগের মানুষ খুঁজি,
উৎসবমুখর মন নিয়ে মুখের আদল খুঁজে ফিরি।

ত্রিশ বছরে অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে গেছে, চিরবিদায় নিয়েছে কেউ কেউ।
অনেক শিশু হয়েছে ভূমিষ্ঠ এই বরেন্দ্রভূমে,
সেদিনের সেই যুবক আজ বার্ধক্যগ্রস্ত হয়ে চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।
অনেক বৃক্ষ হয়েছে নিধন, তার চেয়ে হয়েছে অধিক রোপণ।
আমার লাগানো চারাগাছগুলো আজ ঘরের ছাদ ছাড়িয়েছে,
ছোটবেলায় কত কথা হতো, আর আজ আমি কথা খুঁজে হয়রান!
দূরে পাখ-পাখালির কিচিরমিচির, আকাশে খণ্ড মেঘ
আঙিনায় আতা ফলের ডালে দুটি শালিকের রঙ্গচিত্র,
মায়ের খোঁজে বাছুরের একটানা হাম্বা-হাম্বা ডাক
পুকুরের জলে খেলা করে রাজহাঁস-পাতিহাঁস
বিলের জলে পানকৌড়ি করে লুকোচুরি,
চারদিকে সবুজে সবুজময় তার ভেতরে মায়াময় ঘর-বাড়ি ।
বাতাসে দোলে হিয়া, হেরি আমি গাছ-গাছালির গৃহস্থালি ।
আমি বিস্মিত চিত্তে মুগ্ধ নয়নে ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবি
ভাবতে ভাবতে টুকিটাকি কথা বলি, একসময় ভাব হয় ,
মনে হয় আমি যেন কোনো স্বর্গীয় উদ্যানের ভেতরে
হাওয়ায় হাওয়ায় দেখি কানাকানি, জানা হয় ওদের মন জানাজানি ।
ত্রিশ বছর আগে বুকের ভেতরে যে বৃক্ষটি সুপ্ত ছিল
আজ তার ডালপালা ছুঁয়েছে নীলাকাশ!
মানুষের জন্য এত বছর অনেক তো হলো
এবারে না হয় বৃক্ষের জন্য কাটাই জীবনের বাকিটা সময় ।
গাছের মায়ায় পাতার ছায়ায় সবুজের চাদর গায়ে জড়িয়ে
আমি ঘুমাতে চাই, গাছ-গাছালির ফুরফুরে হাওয়ায় ।
আমি মিশে থাকতে চাই মাটির সোঁদা গন্ধের মায়াবী মায়ায়।
আত্রাইয়ের উর্বর পলিমাটি আমার মেধা ও মনন
বরেন্দ্রভূমিকে ভালোবেসে আজ ধন্য এ জীবন ।

জেগে ওঠে বাংলাদেশ চোখের ভেতর ❤️

এখানে সারা বেলা পাখির ডাক যায় শোনা
কিছু জানা পাখি, কিছু নাম না–জানা ।
নামে কী যায় আসে, ডাকটাই আসল
ডাকের ভেতরে মন্ত্রশক্তি
ডাকের ভেতরেই মন্ত্রপূত ব্রত তিথি ।
আমি মুগ্ধ হয়ে পাখির কথা কান পেতে শুনি
বোঝার চেষ্টা করি ওদের কথোপকথনের ব্যঞ্জনা ।
শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যাই,
হঠাৎ মোরগ ডেকে ওঠে মোরগ চূড়ায় বসে ।
ইথারে ঝংকৃত হয় আমার বিধিলিপি
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত সারেগামা সূর্যালোক
বয়ে আনে আমার প্রশান্ত প্রদীপ ।
আমার মন খারাপটা হঠাৎ কর্পূরের মতো
যায় উড়ে
তখন মন্দাকিনী পিরিতি পীযূষ বয়ে চলে
আমার বুকের ভেতর
বেজে চলে সজোরে রণরণি মন্দিরা সঞ্জীবন
জেগে ওঠে মসজিদ মন্দির
জেগে ওঠে ঈশ্বর
জেগে ওঠে বাংলাদেশ আমার চোখের ভেতর ।