পথচারী

কলেজ থেকে ফেরার পথে ক্লান্ত লাগছে। আজ ভীষণ গরম। পার্কে বড় বড় গাছের নিচে অনেক ছায়া। পলি ভাবল পার্কে একটু বসলে মন্দ হয় না। পানির বোতল খুলে পানি পান করে পার্কের বেঞ্চে খানিকক্ষণ বসার পর হঠাৎ অনেক দূর থেকে একজন ভীষণ বুড়ো পথচারী পলির কাছে এসে বসল। সাথে এসটোলারে বসা একটা তিন বছরের মিষ্টি বাচ্চা। ভদ্রমহিলার পরনে সাদা পরিষ্কার কাপড়। চেহারায় নুরানি ভাব; পান খাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা গো, তুমি কি বাঙালি? কোথায় থাকো? তোমার নাম কী? তোমারে দূর থেইকা দেইখাই আইলাম। এইহানে তো আমাগো দেশের মানুষ কম দেখি। এইখানকার মানুষ খালি হাই-হ্যালো করে। দেশে হইলে এতক্ষণে কত মানুষ দেখতাম; কত কথা কইতাম।’

বুড়ো মহিলার নস্টালজিয়ায় পলি একটু বিব্রত হলো। কলেজ শেষে ক্লান্ত বলেই পলি একটু পার্কে এসে একান্তে বসেছে। কেন যে উনি এসে পলিকে এত কথা জিজ্ঞেস করছেন? পলি ইতস্তত করে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমি বাঙালি।’
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা উত্তর দিল, ‘তোমার মায়াভরা মুখ দেইখাই বুঝছি। তাই তো দূর থেইকা তোমার কাছে আইয়া বইলাম।’ কেন জানি পলির একটু মায়া লাগল মহিলাটির প্রতি। তারপর দুজন দীর্ঘক্ষণ বসে কথা বলল। একসময় ভদ্রমহিলা বললেন, ‘মা গো তুমি কী কর?’

-আমি স্কুলে চাকরি করি।
-ওহন বুঝি স্কুল থেইকা আইছ মা?
-না এ দেশে জুন-জুলাই মাসে স্কুল বন্ধ থাকে।
-তাইলে কই থেইকা আইলা? মুখটা একদম শুকনা লাগতাছে। কিছু খাইছ মা?

পলির মনে হলো একেবারে নিজের মায়ের মতো জেরা করছে। পলি বলল, ‘আমি নিজের জন্য একটু পড়ালেখা করছি। আমার চাকরির জন্য কিছু ক্যাডেট দরকার। আমার একটা ছেলে আছে। ওকে দেখাশোনা করে এত দিন নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি। ছেলে একটু বড় হওয়ায় আবার শুরু করেছি।’

-ঠিক করতেছ মা। শিক্ষা একমাত্র শক্তি মা। আইজ আমি এই দেশে আইয়া ঝিয়ের কাজ করি। বেবিসিটিং করতেছি। পান খাওনের পয়সা ছিল না এক সময়। অনেক কষ্ট হইত। আমার পুতে বাংলাদেশ থেইকা এমএ পাস কইরা এই দেশে আইছিল; একটা চাকরি করে। হের পোলা আছে। নাতি ভারী সুন্দর; তিন বছর বয়স। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আমার স্বামী মারা গেছে। দুই পুত, আর এক মাইয়্যারে আমিই পড়ালেখা শিখাইছি; বিয়া দিছি। অনেক কষ্ট করছি। এহন ওরা বড় হইছে; চাকরি করে ভালা আছে। বড় পুতে বউয়ের বাচ্চা হওনের সময় আমারে এইহানে আনছে অ্যাপ্লাই কইরা। পোলাডা যত দিন বড় হয় নাই আমারে রাখছিল। নাতিডা বড় হইতেই বউ আমারে অপমান শুরু করল। একদিন পুতে আমারে ডাইকা কইল, “মা ,তোমারে আনছিলাম আমার পোলার জন্য। এহন ও বড় হইছে; স্কুলে যায়। তোমার আর থাকার দরকার নাই।” পুতেরে কইলাম, “বাবারে তোমাগো মানুষ করণের লাইগা আমি আর অন্য কোনো চিন্তা করি নাই। সহায়-সম্বল সব বিক্রি কইরা তোমাগো মানুষ করছি। বাকিটা বিক্রি কইরা তোমারে আর তোমার বউরে বিদেশ আসার খরচ দিছি। এহন আমারে চইলা যাইতে কও? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই বাবা। তোমার মামা আমারে সাবধান করছিল। আমি তবুও করছি, কারণ তোমরাই আমার পৃথিবী।”

‘শুইনা বউ কয়, ‘এইহানে থাকতে হইলে আপনার খরচ দিতে হইব। আমি চাকরি করি। আপনার পুতে চাকরি করে। আপনি বইসা খাবেন—এইটা হইতে পারে না।” কইলাম, “ক্যামনে টাকা দিমু? আমি তো কাজ করি না। আমি কইলাম, ‘তোমাগো পুতেরে আমি দেখি, ওর জন্য সবকিছু করছি ওর জন্মের পর থেইকা। রান্না করি। এত দিন এগুলা বইসা খাওয়া তো হয় নাই মা। তুমি যদি বেবিসিটার রাখতা, তোমার পয়সা লাগত না?” সাথে সাথে বউ আমার চুলের মুঠি ধইরা কয়, ‘বুড়ি তুমি খোটা মাইরা কথা কও আমার পোলারে নিয়া; এত বড় সাহস।”
ভদ্রমহিলা বলেই চলেন, ‘নিজের পোলাও কইল, “মা তুমি আমার পোলার জন্য কী করছ? কেমনে এইডা কইলা? সত্যি কথা, আমরা আর মা বাড়তি লোকের খরচ নিতে পারতাছি না। তুমি দেশে যাওগা; নাইলে ঝিগিরি কইরা খাও।”
পলি অবাক হয়ে সেই বৃদ্ধ মহিলার কথা শুনছিল। পলি ভাবছিল এত নির্মম মানুষ কী করে হয়। মহিলা চোখের পানি বারবার মুছছে আর কথাগুলো বলছেন।

-তারপর কী করলেন?
-তারপর মা এ দেশে কাউরে চিনি না। রাস্তা ঘাট জানি না। আমি পান খাইতাম। পয়সা নাই পান কিনতে পারি না। মনে হইত পান ছাড়া আমার মাথা যেন কাজ করে না। মাথা ঘুরায়। একদিন মন ভীষণ খারাপ। এই পার্কে আইয়া বইয়া আছি। হঠাৎ তোমার মতো অল্প বয়সী এক মাইয়া আইসা বইল আমার পাশে। কইল, ‘আপনি কী করেন? কোথায় বাসা?’ কইলাম, ‘এই কাছেই থাকি।’ কইল, ‘খালা আমি আপনার মতো মুরব্বি টাইপ বেবিসিটার খুঁজছি, যে আমার মেয়েকে রাখবে আর আমার জন্য একটু রান্না করবে।’ মনে হইল আল্লাহ এই মাইয়ারে আমার জন্যই পাঠাইছে। কইলাম, ‘তোমার বাসা কই?’ মাইয়াডা কইল, ‘এই তো হিলের ওপর। আমি আর আমার স্বামী দুজনই ডাক্তার। একটা মেয়ে আছে। ওর জন্য একটা বিশ্বস্ত লোক খুঁজছি।’ কইলাম, ‘আমি কাজ করতে চাই। তুমি কি আমারে লইবা মা?’ আমি সাথে সাথে রাজি হইয়া গেলাম। হেই থেইকা ওগো লগে আছি মা। আইজ দুই বছর পার হইল ওগো সাথে আছি। আমি আমার সন্তান হারাইয়া আরেক সন্তান পাইছি। ওরা কয় আমি ওগো মা। এই যে দেখ দুই জোড়া সোনার বালা; ওরা বানাইয়া দিছে। বকাঝকা করি; এত পয়সা কেন নষ্ট করে। পাগল মাইয়া কয়, ‘মায়ের জন্য খরচ করলে পয়সা নষ্ট হয় না। পান খাওয়ার লাইগা বাংলাদেশ থেইকা রুপার পানের বাটা, আর সুপারি কাটার সরতা কিনা আনছে আমার জন্য। এই যে দেখ মোবাইল ফোন কিননা দিছে। এই যে আমার নাতনি; ওদের মাইয়া। নাম অহনা। আমারে নানু কইয়া ডাকে।
এরই মধ্যে ফোন বেজে উঠল।
-আমার মাইয়ার ফোন। ‘আমি আর অহনা ভালো আছি মা। ফল আমি খামু; চিন্তা কইরো না।
পলি দেখছিল এসটোলারে করে অনেক ধরনের খাবার ছোট মেয়েটার জন্য এনে ফাঁকেই ফাঁকেই নাতনিকে খাওয়ানের চেষ্টা করছিল। পলি জানতে চাইল, ‘আচ্ছা আপনার ছেলে আর তার বউয়ের এখন কী খবর?’
-আছে ভালো। ওদের সাথে দেখা হয় মাঝে মাঝে। একমাত্র সরকারি ফুডস্ট্যাম্প ও ট্যাক্সফাইলের চেকের সময় আমার এখানে আসে। আমার সিগনেচার নিতে আসে। আমি সাইন দিয়া দিই। পরে ওরা জমা দিয়া টাকা উঠায়।
-আপনি সাইন দেন কেন? ওরা টাকা তো আপনাকে দেয় না; আপনার জন্য খরচও করে না। ওই টাকায় নিজেরা আনন্দ করে।
-থাক মা ও তো আমারই ছেলে। আমাকে ও মা নাইবা ভাবল। আমি তো মনে করি ও আমার ছেলে। ও যদি আমারডা খাইলে কষ্ট হয় না।
এরই মধ্যে পলির স্বামীর ফোন এল। পলি বলে, ‘আমাকে আজ উঠতে হবে। আরেকদিন কথা বলব।’
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা ছোট একটা বাক্স থেকে দুটো তেলের পিঠা বের করে সাধতে লগলেন। একটা নিল পলি। বলছিলেন, ‘মা আমি তোমার অনেক সময় নিলাম। তোমারে অনেক মায়া লাগছে। ভালো থইক মা। বাসায় চল, হাঁসের মাংস রানছি।’
-আজকে না। আরেকদিন যাব। ফোন নম্বরটা দিল। বলল, ‘খালম্মা কল করবেন।’
যেতে যেতে পলি ভাবছিল জীবনে কিছু মানুষ শুধু পথচারীই নয়। কেমন যেন ব্যথা অনুভব হলো তাঁর জন্য। ভাবল, কী করে এমন মায়াবতী মাকে সন্তান অপমান করে ঘরছাড়া করে? এই মায়াভরা হাতের কত আদর একদিন ওই সন্তান নিয়েছে। তারপরও তার কাছে মায়ের ঠাঁই হলো না। সেই মাকে আজ অন্যের ঘরে কাজ করে খেতে হচ্ছে; বিচিত্র এই দুনিয়া।