আহমদ ছফা: প্রতিবাদী, মানবিক ও জাতির দর্পণ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, জাতির শিক্ষক ও জাতির দর্পণ হিসেবে আহমদ ছফাকে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। অনেকেই আহমদ ছফাকে প্রাবন্ধিক হিসেবে দেখলেও তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট কলামিস্ট। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।

আহমদ ছফা যুবক বয়েসে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর কলম নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে ছিল না। তাঁর কলম অনেকের কাছেই ছিল খুব অস্বস্তিকর। তিনি তাঁর কলমকে অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। বলা হতো, তাঁর মসি ছিল অসির চেয়েও ধারালো। যে সত্য প্রকাশ করতে তাঁর সমকালীন অনেকে হিমশিম খেতেন, তিনি তা অসংকোচে অবলীলায় প্রকাশ করতেন। আহমদ ছফা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন প্রগতিশীল লেখক। অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল ক্ষুরধার। অনেকের মতে, বাংলাদেশে আহমদ ছফার মতো সাহসী লেখক দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি কখনো হিসেব করে লিখতেন না। অত্যন্ত রাগী ছিলেন, কখনো কারও সঙ্গে আপস করেননি। বলা হয়, বাংলাদেশে আহমদ ছফা একজনই। বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক, লেখক ও সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন, তাদের মধ্যে আহমদ ছফাই সবচেয়ে সাহসী, কুশলী, বহুমুখী—এক কথায় অসাধারণ ছিলেন।

মানবিক মূল্যবোধ ও গুণাবলির জন্যও আহমদ ছফা ছিলেন অনন্য। আহমদ ছফা অনেকের জীবনের নানা সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েছেন, বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সহায়তার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। বাংলার নামকরা চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আহমদ ছফা। দুজনই ছিলেন ভবঘুরে, অবিবাহিত এবং খ্যাতি, ধন-সম্পদ বা অন্যান্য বৈষয়িক মোহবর্জিত।

প্রথম দিকে তরুণ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের তেমন পরিচিত ছিল না। শিল্পীমহলের অনেকে তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। এ সময় ছফাই তাঁর পাশে দাঁড়ান। দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। আহমদ ছফা সুলতানের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাশক্তি ও চিত্রকর্মের উচ্চ প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তারপর এস এম সুলতান সবার দৃষ্টিতে চলে আসেন, দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। এর পরের ইতিহাসটা আমাদের সবারই জানা আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হ‌ুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালের বাবা শহীদ হন। সে কারণে সরকার এই অসহায় পরিবারকে থাকার জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর হ‌ুমায়ূন আহমেদদের সেই বাড়ি সরকার নিয়ে নেয়। এ ঘটনা শুনে আহমদ ছফা হ‌ুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ান। হ‌ুমায়ূন আহমেদদের বাড়ি সরকার নিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে আহমদ ছফা নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া লেখক হিসেবে হ‌ুমায়ূন আহমেদকে প্রতিষ্ঠিত করতে আহমদ ছফার অবদান অনস্বীকার্য। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াশোনা করছিলেন, তখন তাঁদের পরিবারে অর্থকষ্ট ছিল। সে সময় আহমদ ছফা মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকা অফিসে কার্টুনিস্টের কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় তরুণ কবি আবুল হাসানের পুনঃভর্তি হওয়া দরকার ছিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু আবুল হাসানের হাতে তখন কোনো টাকা ছিল না। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পারেন। তখন আহমদ ছফা নিজের বই প্রকাশের ‘রয়্যালিটির’ টাকা আবুল হাসানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন পুনঃভর্তি হতে। স্বাধীনতার পর কোনো কারণে কবি ফররুখ আহমেদের সরকারি টাকা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি অসুস্থও ছিলেন। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পেরে খুব ক্ষেপে যান। একজন সাহিত্যিক অসুস্থ, অথচ কোনো এক অজানা অজুহাতে সরকারের তরফ থেকে টাকা প্রদান বন্ধ থাকবে—এটা আহমদ ছফা মেনে নেওয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি বিষয়টি নিয়ে হইচই তুললেন। প্রতিবাদ করলেন। অবশেষে সরকারের তরফ থেকে ফররুখ আহমেদকে টাকা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণকে অজ্ঞাত কারণে আর্মি গ্রেপ্তার করে রমনা থানা হাজতে কাস্টোডিয়ান হিসেবে জমা দিয়েছিল। এই খবর পাওয়া মাত্র নির্মলেন্দু গুণকে ছাড়াতে থানায় ছুটে গিয়েছিলেন ছফা। নির্মলেন্দু গুণকে ছেড়ে দিতে তিনি থানার ওসির সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা পর্যন্ত করেন। সাত দিনের মধ্যেই গুণ ছাড়া পান। আরেক প্রতিবাদী তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। যখন তিনি পাকস্থলীর আলসারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, তখন তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন ছফা। ফিরে আসার সময় টাকা ভর্তি একটি খাম রেখে আসতেন রুদ্রের বালিশের নিচে।

কবি অসীম সাহা এমএ প্রথম পর্ব পরীক্ষার ফরম ফিলাপের আগে অর্থ সংকটে ছিলেন। বিষয়টি অসীম সাহা আহমদ ছফাকে জানান। কিন্তু ছফা নিজেও তখন আর্থিক সংকটে। তাই তিনি অসীম সাহাকে সহায়তা করতে ভিন্ন পদ্ধতি নিলেন। অসীম সাহাকে ‘ডিরোজিও’র ওপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে বলেন। এ জন্য কিছু বইও দেন তাঁকে। অসীম সাহা পাণ্ডুলিপিটি দ্রুত তৈরি করে দিলে, ছফা তা ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ নামক প্রকাশনীতে জমা দেন। প্রকাশকের কাছ থেকে ওই বই বাবদ অগ্রিম ২০০ টাকা এনে অসীম সাহার হাতে তুলে দেন। অসীম সাহা বলেছিলেন, ‘বস্তুত ছফা ভাইয়ের চেষ্টা এবং উদ্যোগে আমার এমএ পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. নাজমা শাহীনের বিয়ের সময় তাঁর বাবা অর্থসংকটে পড়েন। নাজমা শাহীনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য আহমদ ছফা নিজের সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি বাংলাবাজারে কোনো এক প্রকাশকের কাছে বিক্রি করে টাকাটা নাজমা শাহীনের বাবার হাতে ধার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন। কবি ও লেখক শিহাব সরকার ও মোরশেদ শফিউল আর্থিক সংকটে পড়ে আহমদ ছফার কাছে এলে তিনি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। এমন অনেক মানবিক ঘটনাই আছে, যা আহমদ ছফাকে বিরলপ্রজ মানবিক মূল্যবোধের লেখকের মর্যাদা দিয়েছে।

ষাটের দশকে সাহিত্য জগতে পা রাখেন আহমদ ছফা। সমসাময়িক উপন্যাস লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। বক্তব্যের স্পষ্টতা আর তীব্রতার জন্য খুব দ্রুত পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলেন তিনি। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীনতার পথে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। পরে বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনি সব ক্ষেত্রেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তাঁর লেখাগুলোর দিকে তাকালে একটি বিষয় নজরে পড়বে। প্রায় প্রতিটি লেখাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে। সাধারণত ছোট ভলিউমে বই বের করতেন আহমদ ছফা। এই ছোট বইগুলোই চট করে পাঠকদের মনে জায়গা করে নিত, কারণ তাতে থাকত গণমানুষের কষ্টের প্রতিফলন, তাদের জীবনের দুর্দশার চালচিত্র।

তিনি প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধমূলক গ্রন্থগুলো সর্বাধিক আলোচিত ছিল। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ (১৯৭১), ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭২), ‘বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে’ (১৯৭৫), ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ (১৯৭৭), ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৮১), ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৯), ‘রাজনীতির লেখা’ (১৯৯৩), ‘নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ’ (১৯৯৫), ‘সংকটের নানা চেহারা’ (১৯৯৬), ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৯৭), ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (১৯৯৮), ‘বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ (২০০১), ‘আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (২০০২), ‘সেই সব লেখা’ (২০০৮) ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য তুমি সাথী’ (১৯৬৭), ‘উদ্ধার’ (১৯৭৫), ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ (১৯৮৯), ‘অলাতচক্র’ (১৯৯০), ‘ওঙ্কার’ (১৯৯৩), ‘গাভীবিত্তান্ত’ (১৯৯৪), ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ (১৯৯৬), ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’ (১৯৯৬) ও ‘নিহত নক্ষত্র’ (১৯৬৯)। কবিতার ক্ষেত্রেও সমুজ্জ্বল ছিলেন আহমদ ছফা। ‘জল্লাদ সময়’ ও ‘দুঃখের দিনের দোহা’ (১৯৭৫), ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ (১৯৭৭), ‘লেনিন ঘুমোবে এবার’ (১৯৯৯), ‘আহিতাগ্নি’ (২০০১) তাঁর কাব্যগ্রন্থ। অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ, লোকজ ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে তাঁর কবিতাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আহমদ ছফার অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এ ছাড়া তিনি ভ্রমণ কাহিনি, কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়ার বই রচনা করেছিলেন।

বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের অন্যতম প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল লেখক আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া ছিলেন একজন কৃষক এবং মা আসিয়া খাতুন ছিলেন গ্রাম্য গৃহিণী। দু ভাই, চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার হাতে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় ছফার। ১৯৬০ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। যদিও সেখানে খুব বেশি দিন ক্লাস করেননি ছফা। খুব সম্ভবত ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন ছফা। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন আর সম্ভব হয়নি। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন কলেজের শিক্ষক ও পরে পত্রিকার সম্পাদক। তবে লেখালেখির মাধ্যমে প্রকাশিত বই বিক্রির টাকাই ছিল তাঁর মূল আয়। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে আহমদ ছফাকে সরকারের উচ্চ পদে চাকরির আহ্বান করা হলেও স্বাধীনচেতা মানসিকতার কারণে তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।

আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকর ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাঁদের মধ্যে হ‌ুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ ও সলিমুল্লাহ খান অন্যতম। হ‌ুমায়ূন আহমদ আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাঁকে নিজের মেন্টর বলে উল্লেখ করেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, আহমদ ছফা ‘চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক’। ইকবাল আরও লিখেছেন, ‘আমাদের বড় সৌভাগ্য তাঁর মতো একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।’ জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ‘ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে, যে জগতে যেকোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।’

বর্তমানে আহমদ ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত। এই কীর্তিমান ২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁর দাফন হয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ‘লেখক শিবির পুরস্কার’ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮০ সালে ‘ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার’ ও ২০০২ সালে ‘মরণোত্তর একুশে পদক’ এ ভূষিত হন আহমদ ছফা। তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট