উপনিবেশ বানানোর পরিকল্পনা

১৯তম পর্ব

পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশিকরণ: পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পূর্ব বাঙলা নীতি স্পষ্টতই প্রমাণ করে, যারা পাকিস্তান শাসন করছে তারা স্ববিরোধিতায় ভুগছে। গোড়াতে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের ভুল থেকে সরকার সরে না এসে একগুঁয়েমি আচরণ করছে। এর পেছনে কিছু ভাসা-ভাসা যুক্তি আছে তবে তা খুব জোরালো নয়।

পূর্ব বাঙলাকে অধীনে রাখতে ব্যাপক শক্তি প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে প্রতিদিন সরকারের বিপক্ষে হাজার হাজার নতুন শত্রু জন্ম নিচ্ছে, একই সঙ্গে পাকিস্তানের দুই অংশের বিভক্তিকে নিশ্চিত করছে।

অন্যদিকে কঠিন প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণে এবং বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষ করে আমেরিকার চাপে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। ২৫ মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুন মাসের মাঝামাঝি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের পরিকল্পনা জানাবেন।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট মোকাবিলায় সামরিক সরকার সমাধানের বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করছে। আমার নিজের সুযোগ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার এবং পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা নিজে দেখার। পূর্ব পাকিস্তানকে যে উপনিবেশে পরিণত করতে হবে এই বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো স্ববিরোধিতা নেই। এটি আমার নিজস্ব আবেগ তাড়িত বক্তব্য নয়।

১৬ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাসে আমি নবম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রেজার সঙ্গে কথা বলছিলাম, আমার চূড়ান্ত প্রশ্ন ছিল, হত্যা কি বন্ধ হবে? তিনি বললেন, ‘আপনি একেবারে নিশ্চিত হতে পারেন আমরা বিনা কারণে এই রকম কঠোর এবং ব্যয়বহুল অপারেশন শুরু করিনি। আমরা এটা শেষ করব। অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় এটা আমরা পলিটিশিয়ানদের কাছে দিতে পারি না, তাহলে তারা এটাকে আবার জগাখিচুড়ি পাকাবে।

সেনাবাহিনী প্রতি তিন/চার বছরে বারবার আসতে পারে না। এটি খুব একটি জরুরি কাজ। আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি, যখন আমরা শেষ করব, এরপর আমাদের আর কখনো এই কাজে আসতে হবে না।’

মেজর জেনারেল শওকত রেজা মাঠের তিন বিভাগীয় কমান্ডারের একজন, যিনি একটি মূল পদে আছেন। তিনি তাঁর নিজের যা মনে হয়েছে তা বলেননি, নীতি নির্ধারকদের কথাই তার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রণিধানযোগ্য যে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার ১০ দিনের সফরে প্রত্যেক সেনা অফিসার যাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, সবার কথাতেই জেনারেল শওকত রেজার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও জানেন, মাঠে কর্মরত সেনারাই কার্যত পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারক।

সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই যথেষ্ট মূল্য দিয়েছে। শোনা যায়, এই যুদ্ধে হতাহত সৈনিকের সংখ্যা ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান–ভারত যুদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে। সেনাবাহিনী তাদের এই আত্মত্যাগকে রাজনীতিকদের জন্য ব্যর্থ হতে দেবে না, কারণ রাজনীতিকেরা এই অবস্থার জন্য দায়ী। সেনাবাহিনী এই পর্যায়ে কোনো বিকল্প ভাবছে না, হয় সামগ্রিক জয় অথবা পরাজয়। সেনাবাহিনী মনে করে, সময় এখনো তাদের সঙ্গে আছে এবং বিদ্রোহীদের চেয়ে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আমি ঢাকা, রাওয়ালপিন্ডি ও করাচিতে সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, তারা দ্রুত তাদের অপারেশন সমাপ্তির মধ্যেই সমাধান দেখছেন। সেনা প্রত্যাহারের কোনো চিন্তা তারা করছেন না। এই অপারেশনের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন হচ্ছে, তা ইতিপূর্বের সব পরিকল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বর্তমানে সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ আছে। এক বাক্যে সরকার পূর্ব বাংলা থেকে সেনা অপসারণের কোনো চিন্তা করছে না—যদিও রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঘের পিঠে চড়েছেন এবং চড়েছেন অনেক হিসাব নিকাশ করেই।

ঢাকায় আর্মির ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়াটার পূর্ব বাংলা সম্পর্কে তাদের যে নীতিমালা আমাকে পড়ে শোনান তার মধ্য প্রধান তিনটি উপাদান ছিল—
১. বাঙালিরা প্রমাণ করেছে তারা অ-নির্ভরযোগ্য ও তাদের পাকিস্তানের দ্বারাই শাসিত হতে হবে।
২. বাঙালিদের যথাযথ ইসলামিক শিক্ষায় পুনরায় শিক্ষিত করতে হবে।
৩. হিন্দুদের হত্যা ও বিতরণের মাধ্যমে তাদের সম্পত্তি দখল করে তা দরিদ্র মুসলিমদের মধ্য বিতরণ করা হবে এবং এভাবে তাদের সমর্থন আদায় করা হবে।

যেহেতু বাঙালিরা বিদ্রোহ করেছে, তাই সরকারিভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাদের আর সামরিক বাহিনীর কোনো শাখাতেই স্থান দেওয়া হবে না। সিনিয়র এয়ারফোর্স ও নেভি অফিসারদের সাবধানতা হিসেবে গুরুত্বহীন দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে। বিমানের বাঙালি পাইলটদের গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। এমনকি পিআইএর পাইলটদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহে অংশগ্রহণের পর তাদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের স্থলে নতুন সিভিল ডিফেন্স ফোর্স গঠন করা হয়েছে যেখান নির্বাচন করা হয়েছে ভারত থেকে আগত বিহারি ও পাকিস্তানের বিহারি সম্প্রদায়কে। তাদের পরিচালনা করার জন্য আর্মিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

চাঁদপুরের পুলিশ সুপার হিসাবে একজন আর্মি মেজরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শত শত বেসামরিক কর্মকর্তা, ডাক্তার, রেডিও ও টিভির টেকনিশিয়ান, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের কর্মকর্তাকে পূর্ব বাঙলায় নিয়োগ করা হয়েছে। কোনো কোনো কর্মকর্তাকে প্রমোশন দিয়ে আনা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বদলি করা যাবে বলে এক আদেশ জারি করেছেন। আমাকে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলার সব কমিশনার এবং ডেপুটি কমিশনারকে হয় বিহারি অথবা পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। ডেপুটি কমিশনারদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনারকে গুলি করে হত্যা করে, কারণ তিনি ২০ মার্চ শেখ মুজিবের লিখিত আদেশ ছাড়া আর্মির জন্য পেট্রল ও খাদ্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করেন।

সেনাবাহিনী ইউনিভার্সিটিগুলোর প্রতি অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। কারণ তাঁরা মনে করেন, এটিই হলো বিদ্রোহের মূল আস্তানা। ইতিমধ্যেই অনেক প্রফেসর পালিয়ে গেছে এবং অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারা এখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রফেসরদের এনে এই শূন্য স্থান পূরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব ফেরেন সার্ভিস অফিস থেকেও বাঙালি অফিসারদের সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

কুমিল্লার মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মেজর আগা বলেন, উপনিবেশ তৈরি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি উদাহরণ দেন, কুমিল্লার আশপাশে সেতু এবং রাস্তা মেরামতের জন্য বাঙালি ইঞ্জিনিয়াররা সঠিকভাবে কাজ করছেন না বলেই তা মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না।

পূর্বাঞ্চলকে উপনিবেশ বানানোর রূঢ় বাস্তবতা হলো লজ্জাহীনভাবে অনেক বিষয়কেই সাজানো গোছান হিসাবে দেখাতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট টিক্কা খান পূর্ব বাংলায় যা করছেন, তার পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন লাভের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ফলাফল তখন পর্যন্ত খুব আশাপ্রদ হয়নি। এই পর্যন্ত যাদের সমর্থন পাওয়া গেছে তারা হলেন মাওলানা ফরিদ আহমদ, যিনি ঢাকার একজন আইনজীবী, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও জামায়াতই ইসলামের প্রফেসর গোলাম আজম—যারা প্রত্যেকেই গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন।

শুধু প্রণিধানযোগ্য নেতা নুরুল আমীন, যিনি একজন পুরোনো মুসলিম লীগার এবং এক সময়কার প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার। জাতীয় নির্বাচনে যে দুজন আওয়ামী লীগের বাইরে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি তাদের একজন। তাঁর বয়স এখন সত্তরের কোঠায়, যদিও সমর্থন দানের বিষয়ে তিনি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। তিনি এই পর্যন্ত যে দুটি বিবৃতি দিয়েছেন সেখানে শুধু ‘ভারতের হস্তক্ষেপ’ ছাড়া অন্য বিষয়ে কিছু ছিল না।

এ ছাড়া সামরিক সরকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত ৩১ জন আওয়ামী লীগের সদস্যকে ঢাকায় আটকে রেখেছেন, যারা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই সদস্যরা এখন নিজেদের ছাড়া কারও প্রতিনিধিত্ব করেন না।

আবদুল বারি সেই দরজি যাকে নিয়ে এই কাহিনি শুরু, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় যিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন, তার বয়স ছিল ২৪ বছর। পাকিস্তানের বয়সও তার সমান। আর্মি অবশ্যই জোর করে পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্রিত রাখতে পারে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন নিয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য ভোট দিয়েছিল, তাদের স্বপ্ন আজ ম্লান হয়ে গেছে। পশ্চিমের পাঞ্জাবি আর পূর্বের বাঙালিরা অদূর ভবিষ্যতে এক জাতি হিসাবে থাকবে—সেই আশা একেবারেই ক্ষীণ। যদি উপনিবেশ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তবে বাঙালিদের জন্য ভবিষ্যৎ অত্যন্ত বর্ণহীন ও অসুখী। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]