নিউইয়র্কে বাংলাদেশি ফুডকার্ট

আমেরিকার জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান শহর নিউইয়র্ক। ব্রুকলিন, কুইন্স, ম্যানহাটন, ব্রঙ্কস এবং স্ট্যাটান আইল্যান্ড নিয়ে এই মহানগরে আনুমানিক ৮৫ লাখ লোকের বাস। ২২ কিলোমিটার লম্বা ও প্রায় ৪ কিলোমিটার প্রশস্ততা নিয়ে শহরের মূল কেন্দ্র ম্যানহাটনের মোট স্থায়ী অধিবাসীর সংখ্যা ১৭ লাখ। দিনের বেলায় যা ৩০ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। মূল কারণ হলো, বাণিজ্যিক নগরে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক কার্যক্রম। দানবীয় আকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শুধু শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকা নয়, নিউইয়র্কের পাশের শহরগুলো থেকে কয়েক লাখ মানুষ ট্রেন, বাস ও নিজস্ব গাড়িযোগে নিউইয়র্কে আসে প্রতিদিন।

শহরের মোট বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে প্রতি মাসে মিলিয়ন ডলার উপার্জনকারী চাকরিজীবী যেমন আছেন, তেমনি ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ১৫ (বর্তমান) ডলার উপার্জনকারীর সংখ্যাও কম নয়। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জন্য বাসস্থান, নিরাপদ যোগাযোগসহ সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্যের সহজলভ্যতা। বাণিজ্যিক মহানগর নিউইয়র্কের নিউক্লিয়াস বলে খ্যাত ম্যানহাটনের প্রতিটি অ্যাভিনিউ ও স্ট্রিটে সব ধরনের খাবার প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। দুনিয়ার প্রতিটি দেশের খাবার নানা নামে, নানা বৈচিত্র্য নিয়ে, প্রস্তুত এবং পরিবেশন করা হচ্ছে নিয়মিত। প্রাচ্য হতে পাশ্চাত্য, রাশিয়া থেকে আফ্রিকা মহাদেশের সব দেশের মুখরোচক সকালের নাশতা, দুপুরের লাঞ্চসহ রাতের খাবারের পরিবেশনে হাজারো রেস্টুরেন্টের দেখা মেলে ম্যানহাটনের চারদিকে, যা থেকে নগর কর্তৃপক্ষ রাজস্ব আয় করে থাকে লাখ লাখ নগদ ডলার।

নগরের প্রতিটি স্থানে স্বল্প আয়ের অথবা বেশি আয়ের কর্মজীবীদের জন্য খাবার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এর মধ্যেই নানা স্ট্রিট ও অ্যাভিনিউয়ে ছোট্ট ঘরের আকারে কিছু খাবার দোকান দেখা যায়। ওদের বলা হয় ফুডকার্ট। বাংলায় চলমান খাবারের দোকান। নিউইয়র্কে ওরা খুবই জনপ্রিয়। নগরবাসী ডাকে ফুড কার্ট। যেখানে আইসক্রিম হতে সকালের ব্রেকফাস্ট, রাতের কিংবা দুপুরের খাবার পরিবেশিত হয় স্বাস্থ্যমান বজায় রেখে। ফুডকার্ট পরিচালনার অনুমতি ও স্বাস্থ্যমান রক্ষার নিয়মাবলি খুবই কঠোর, যা নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

নিউইয়র্কের রাস্তায় চলমান গাড়িতে খাবার বিক্রি করার ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। মূলত এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় আমেরিকাতে আসা অভিবাসীদের মাধ্যমে। পরে তা দ্রুত পথচারী ছাড়াও ম্যানহাটনে কর্মরত লক্ষাধিক পেশাজীবীর মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইহুদি অভিবাসীরা রাস্তায় পিনাট অ্যান্ড পিকল নামে একজাতীয় খাবার বিক্রি করত। যেটি পিপি বলে নিউইয়র্কবাসীর কাছে বেশ জনপ্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠে। সময়ের ব্যবধানে অন্যান্য দেশের অভিবাসীরাও শুরু করে নিজস্ব ঘরানার খাবারের ব্যবসা। সঙ্গে আইসক্রিম।

শুরুর দিকে এই ফুডকার্টকে সবাই ওপেন কিচেন বলে জানতেন। লাইন ধরে খাবার গাড়ি থেকে দুপুর বেলা ক্ষুধার্ত নিউইয়র্কবাসীর খাবার কিনে খাওয়ার চিত্র ১৯০৬ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় হরহামেশাই দেখা যেত। উনিশ শতকের শুরুতে মুসলিম অভিবাসীদের আগমন শুরু হলে সেই দেশগুলির আচার ও অভ্যাস নিউইয়র্ক শহরে পরিলক্ষিত হতে থাকে। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিরাট সংখ্যক মুসলিম পেশাজীবীদের চাহিদা পূরণে হালাল খাবারের প্রয়োজনে শুরু ফুড কার্টে হালাল খাদ্যের ব্যবসা। কেউ কেউ আবার মিসরের রাস্তায় ‘কুসারি’ নামে সাদা ভাতের সঙ্গে ডাল, টমেটো দিয়ে পরিবেশিত খাবারকে জনপ্রিয় জায়ারোর উত্তরসূরী বলে মনে করেন।

২০০৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমস–এর পরিচালিত এক জরিপের পরিসংখ্যানে জানা যায়, আগে এই ব্যবসাতে মিসরীয়দের প্রাধান্য থাকলেও বর্তমানে এতে বাংলাদেশি ও আফগানদের আধিক্য বেশি। ১৯৯০ সালে হালাল ফুডকার্টের সংখ্যা শতকের মত থাকলেও বর্তমানে হাজারের বেশি হয়ে গেছে। নিউইয়র্কের সব ধরনের পেশাজীবীদের মধ্যে ফুডকার্টের খাবার খুবই জনপ্রিয়, বিশেষ করে ট্যাক্সিক্যাব চালকদের জন্য তা বেশ উপযোগী। তাই বলেই হয়তো তাদের অনেকেই এই সুস্বাদু খাবারের দারুণ অনুরাগী। তা ছাড়া স্বল্প বাজেটের এই খাবারের নামেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। চিকেন বা ল্যাম্ব জায়ারো, যা রুটি এবং পোলাও রাইসের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। শত ভাষাভাষী ও অজানা সংখ্যক সংস্কৃতির মহামিলনের তীর্থ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত নিউইয়র্ক শহরের শত শত স্মারকের একটি হলো এই ফুডকার্ট।

নগর কর্তৃপক্ষ খাবারপ্রেমীদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে শতবাগ সতর্ক তেমনি, এর মানবিক দিকটি নজরে রাখেন নিয়মিত। পাক–ভারত উপমহাদেশ থেকে আসা নতুন অভিবাসীদের মধ্যে অনেকের বিশেষ যোগ্যতার ঘাটতি থাকলেও এই খাদ্য প্রস্তুত শিল্পে ভারতীয়রা স্বল্প সময়ে দারুণ উৎকর্ষ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে জনপ্রিয় হালাল ফুডকার্ট অনেক উপমহাদেশি অভিবাসীর কর্মসংস্থানের নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র। বিশেষ করে বর্তমানে মালিকানা ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা খুবই ভালো করছেন। এমন কয়েকজন বাংলাদেশি আছেন যাদের ৫০টির বেশি ফুডকার্টের মালিকানা আছে। নতুন পুরোনো বাংলাদেশি অভিবাসীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনকি *হাইজিন লাইসেন্স গ্রহণে সহায়তা করে কর্মদক্ষ করতে কখনো পিছপা হননি।

ফুডকার্টের সুনাম ও জনপ্রিয়তা শুধু নিউইয়র্ক কিংবা আমেরিকার সীমানায় নয়। তা আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে সুদূর যুক্তরাজ্যে পৌঁছে গেছে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেবিড ক্যামেরুন ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ম্যানহাটনের এক হালাল ফুডকার্ট হতে জায়ারোর স্বাদ গ্রহণ করেন। মজার ব্যাপার, সেই জায়ারো প্রস্তুতকারী ছিলেন বাংলাদেশি। তার সচিত্র প্রতিবেদন ফলাও করে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নগরী নিউইয়র্কের আনাচে–কানাচে চালু থাকা এসব ফুডকার্ট অভিবাসীদের গৌরবগাঁথা প্রচার করে যাচ্ছে বলে অনেক নগরবিদরা মনে করেন।