সমাজের প্রতি ঘৃণা জন্মাবে তুবার

গুজবের বলি হল তসলিমা বেগম রেনু। ঢাকার উত্তর বাড্ডার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তির খোঁজ নিতে গেলে ছেলেধরা সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মারা হয়। মা হারা হল দুটি সন্তান। ছোট ছোট দুটি অবুঝ শিশু বঞ্চিত হল মায়ের মমতা থেকে।

রেনুর শিশু মেয়ে তুবাকে জিজ্ঞেস করা হলে বলে, আম্মু ড্রেস আনতে গেছে। আগের ঈদে হয়তো রেনু মেয়েকে ড্রেস কিনে দিয়েছে। নতুন ড্রেস পেয়ে প্রজাপতির মতো আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে। এবারও হয়তো পাবে, কেউ কিনে দেবে। কিন্তু তার মাকে জড়িয়ে ধরে আর বলা হবে না, আম্মু আমার পুতুলের জন্য ড্রেস কিনলা না? রেনু খিল খিল করে হেসে উঠে আর বলবে না, তুই তো একটা পুতুল। মায়েদের কাছে সন্তানের কত কত অদ্ভুত আবদার থাকে! অন্যদের ভয়েও বলে না বা বলতে সাহস পায় না। মা তো মা। মায়ের কোনো বিকল্প নেই।

সামনে ঈদ আসছে। তুবার আর মায়ের বুকে মাথা রেখে অভিমানের সুরে বলে উঠে হবে না, এবার আমারে এই লাল রঙের জামাটা কিনে দিবা। রেনুরও বলা হবে না, তোর লাল রং এত পছন্দ? কার মতো হইছস? আমার তো লাল পছন্দ না। আচ্ছা কিনে দেব। তুবার আগ বাড়িয়ে আর বলা হবে না, আচ্ছা, আম্মু এইবার কি আমরা ঈদে শিং অলা বড় গরু কিনব? আমি কিন্তু শিংঅলা গরু ভয় পাই। এই যে মায়ের সঙ্গে আদিখ্যেতা, তা আর কখনই করা হবে না তুবার। এসব তার স্মৃতির পাতায় থাকবে অস্পষ্ট হয়ে।

আহারে অবুঝ শিশু। কোনো একদিন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভাববে আম্মু কই? কেন আসে না। হাতড়ে খুঁজবে সারা বিছানা। ভয়ানক কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠলে মায়ের বুকে আর মাথা রেখে বলা হবে না, আম্মু আমার ভয় করছে। আমারে জড়ায়ে ধর।

তুবার মাথার ওপর বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দেওয়া মা যে আর ফিরে আসবে না, এই শিশু এখনো বুঝতে পারেনি। জীবনে যখন আস্তে আস্তে শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখবে, অনুভব করতে পারবে মা ছাড়া তার জীবন কতটা শূন্য। বুঝতে পারবে, এ সমাজের কিছু অন্ধ, অসভ্য মানুষরূপী অপদার্থ তার মাকে মেরে ফেলেছে। তখন এই সমাজের প্রতি তার ঘৃণাই হবে।...সন্তানদের আশ্রয় হল মা। একটা অবুঝ শিশু যখন কথা বলতে শিখে, তখন সে মা ডাকটি প্রথমে দেয়। শুনে মায়ের অন্তর জুড়িয়ে যায়। মা স্বপ্ন বুনতে থাকে তাকে মানুষ করে গড়ে তোলার।

শিশুটি বড় হতে থাকে মায়ের আঁচল ধরে। মা তাকে গল্প শোনায়, সে হাসে, বায়না ধরে আরও গল্প শোনাতে। খেতে না চাইলে মা কত রকমের কথা বলে খাওয়ায় বাচ্চাদের। মায়ের স্টোরে গল্পের ভান্ডার থাকে। তারা বুঝতে পারে, কোন গল্প বললে বাচ্চা খাবে। মাছের টুকরা দেখিয়ে বলবে এইটা শুধু তোর জন্য। কয়টা খাবি বল, সব দিয়ে দেব। কিংবা কার্টুন দেখতে দেয়। এখন তো মোবাইলে গেম খেলে বাচ্চারা। যে গেম বাচ্চার পছন্দ সেটা দিয়ে খেলা দেখার ছলে খাইয়ে দেয়। তুবার হয়তো এমন অনেক স্মৃতি আছে, না থাকার কথা না। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে সবার শৈশবের গল্প প্রায় একই রকম। আর না খেলে মা ধমক দিলে অভিমান করে, রাগ করে। আবার একটু পর ভুলে গিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠে দৌড়াতে থাকে। শিশুরা হাসছে, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে! মায়ের মনও তখন আনন্দে দোলে উঠে।

তুবা যখন একটু বুঝতে শিখবে, দেখবে তার মাকে পেটানোর ছবি, ভিডিও বিভিন্ন জায়গায় কেমন লাগবে তার? এত এত ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বের হয়েছে যে তার চোখে পড়বেই। তা ছাড়া এখন না বুঝলে যখন একটু একটু বুঝতে শিখবে, তখনই সত্য সামনে আসবে, কান্নায় তার চোখ ভারী হয়ে যাবে। মনের মধ্যে জমতে থাকবে ঘৃণা, ক্ষোভ। যে ঘৃণা বুকে চাপা পড়ে থাকবে আগুনে পুড়ে যাওয়া চাইয়ের মতো।

আর আমাদের সমাজের যে অবস্থা, কিছু জানতে চাইলে চৌদ্দজন সেটা আগ বাড়িয়ে বলে দেয়। কেউ তার দুঃখ ভুলে থাকতে চাইলেও সমাজের মানুষের জন্য ভুলতে পারে না। শুধু তুবা নয়, এ রকম বহু সন্তান আছে যাদের পরিবারের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নির্মমতা, যন্ত্রণা। বর্তমানে সমাজে গুজব মহামারি আকার ধারণ করেছে।

ধর্মান্ধ, অসভ্য, সুযোগসন্ধানী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন—এরাই গুজব ছড়ায় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। গত কয়েক দিনে যা দেখছি সমাজে এদের সংখ্যাই বেশি। এবং গুজব বিশ্বাসও করে ওই ধরনের মানুষেরা।

দেশের প্রতিটি মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজে সি সি ক্যামেরা থাকলে দেখা যেত, ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র। পত্রিকার পাতায় যা আসে, বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি। কোনো কোনো এলাকায় তো প্রভাবশালী এত প্রভাব বিস্তার করে যে, অপরাধীরা তাদের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। সমাজে অপরাধীরা ঘুরে বেড়ায় আর তুবার মতো সন্তানেরা হয় মাতৃহারা।

এই সমাজ রেনুকে বাঁচতে দেয়নি। একজন মা-হারা সন্তানের জন্য কী কষ্ট, সেটা শুধু সেই সন্তান বুঝবে। মায়ের মমতা ছাড়া বড় হতে থাকবে তুবা ও তার ভাই। বিশেষ করে আমাদের সমাজে মেয়েদের প্রতিবন্ধকতা বেশি থাকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। আর তুবা তো অবুঝ। এই অবুঝ শিশুটি যখন বুঝবে এই সমাজের মানুষ বিনা দোষে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তার মাকে মেরে ফেলেছে, সেই সমাজের প্রতি ঘৃণা জন্মাবে তার সেটাই স্বাভাবিক।