স্থায়ী হচ্ছে উবার-লিফট ক্যাপ!

৭০ বছর আগে নিউইয়র্ক নগরী তার প্রথম মেডালিয়ন ট্যাক্সি চালু করে। যাত্রী পরিবহনে ক্যাব কোম্পানিগুলোর নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। অবশ্য পরে এটি ব্যাংক ও ঋণদাতাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়, যার পুরোটাই হয়েছে কঠোর পরিশ্রমী ও অভিবাসী-সংখ্যাগরিষ্ঠ চালকদের কারণে। এখন নগরীর মেয়র বিল ডি ব্লাজিও অ্যাপভিত্তিক ফর-হায়ার গাড়ির ক্ষেত্রে এমনই এক পদ্ধতি প্রণয়নের পরিকল্পনা করছেন।
দীর্ঘ দিন ধরে মেডালিয়ন পদ্ধতির কারণে চালকেরা হয় চড়া দামে লিজ নিয়ে ক্যাব চালিয়েছেন, অথবা ঋণ নিয়ে ক্যাবের মালিক হয়েছেন। এতে ব্যাংক, ঋণদাতা ও ট্যাক্সি টাইকুনরাই বিত্তবান হয়েছেন। কিন্তু যারা মাথার ঘাম ফেলে মেডালিয়ন পদ্ধতি চালু রেখেছেন, সেই চালকেরা মাসিক বিল পরিশোধ করতেই হিমশিম খেয়েছেন। উপরন্তু টিএলসিসহ সিটির সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ক্যাব চালকদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ নীতি, আইনের পক্ষপাতদুষ্ট প্রয়োগ ও মন্দঋণ প্রক্রিয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নিউইয়র্কের ক্যাব চালক কমিউনিটির ভেতর এমন হতাশার সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন চালক আত্মহত্যা করেছেন। 

নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বর্ণনা করেছে কীভাবে ব্যাংকগুলো মেডালিয়নের পাতানো পদ্ধতি ব্যবহার করে লিজ বা ঋণের চক্রে ডুবিয়ে রেখে চালকদের নিষ্পেষণ করেছে। এক বিশেষজ্ঞ তো এটাকে ‘আধুনিক দিনের দাসত্ব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
অ্যাপ–ভিত্তিক ক্যাব এ ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে ভিন্নতা। এখানে একজন ব্যক্তি মেডালিয়ন পদ্ধতির বাইরে থেকে আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। চালকেরা ১২ ঘণ্টার নির্ধারিত শিফটের বদলে নিজের পছন্দমতো সময়ে কাজ করতে পারেন এবং ভাড়ার মোটামুটি একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চালকদের পকেটে আসে। উবার-লিফটের আওতায় গাড়ি চালিয়ে নিউইয়র্কে একজন ব্যক্তিকে জীবিকা নির্বাহ করতে কোনো ঋণের পাহাড় মাথায় নিতে হয় না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিউইয়র্ক নগরী ও ব্যাংকগুলোই আরেকটা নতুন পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চালকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ডলার হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
উবার-লিফটে ক্যাপিং (নতুন লাইসেন্স প্লেট ইস্যু বন্ধ করা) স্থায়ী করে নেওয়ার মেয়র ডি ব্ল্যাজিওর প্রস্তাব অনুমোদন পেলে হাজার হাজার চালক-মালিককে দেউলিয়া হতে পারেন। এই পদ্ধতি নতুন নামে আরেক মেডালিয়ন পদ্ধতিই সামনে আনছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
নতুন ফর-হায়ার প্লেট ইস্যু বন্ধ হয়ে গেলে যারা দীর্ঘদিন থেকে ভাড়ায় উবার বা লিফটে গাড়ি চালাচ্ছেন, তাদের পক্ষে একটা ফর-হায়ার ক্যাবের মালিক হওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে। এতে নতুন যারা গাড়ি কিনে লাইসেন্স প্লেট রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় আছেন, তাদের স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। এ অবস্থায় একজন নিউইয়র্কবাসীর উবার-লিফটে জীবিকা শুরু করতে গাড়ি ভাড়ায় নেওয়া ছাড়া আর বিকল্প থাকবে না। নিজে গাড়ি কিনে চালানোর চেয়ে অধিক ব্যয়বহুল এবং সর্বোপরি এই পদ্ধতি অনিয়ন্ত্রিত বা অর্ধ-নিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে এর ভাড়া ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।
নিউইয়র্ক সিটির ট্যাক্সি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেয়রের এই প্রস্তাবে ড্রাইভারদের চূড়ান্তভাবে অবহেলা করা হবে এবং তাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে শোষণ করে বিত্তবান হওয়ার চাবিকাঠি তুলে দেওয়া হবে ফ্লিট মালিকদের হাতে যারা নিরীহ ড্রাইভারদের থেকে ইচ্ছামতো অঙ্কের রেন্ট চার্জ করতে পারবে। কারণ, এখানে টিএলসি ইস্যুকৃত লাইসেন্স প্লেটগুলো মেডালিয়ানের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। যে অল্পসংখ্যক ব্যক্তির একাধিক ইউনিট কেনার সামর্থ্য আছে, তারা নিলামের মাধ্যমে প্লেটগুলোর মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেবে। মূল্য পরিশোধ করার ভার চাপবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ড্রাইভারদের ঘাড়ে। অনেকেই মনে করেন, সিটির নিয়ন্ত্রকেরা একটা ব্যর্থ মেডালিয়ান পদ্ধতিকে আরেকটা ভ্রষ্ট পদ্ধতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে তার থেকে ভালো ফল পাওয়ার দুরাশা করছেন।
রিপোর্টে দেখা যায় ক্যাপিংয়ের কারণে রেন্ট করতে বাধ্য হওয়ায় একজন ড্রাইভারকে প্রতি বছরে অতিরিক্ত আট হাজার ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। বছরে দু লাখ আঠান্ন হাজার ডলার বেতন পাওয়া এবং ব্রুকলিন দুটো প্রোপার্টির মালিক মেয়রের জন্য এটা তেমন বড় অঙ্ক নয়। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া সাধারণ লোকের জন্য কষ্টকর।
মেয়রের এসব প্রস্তাবের কারণে ২০১৩ সালের তাঁর নির্বাচনী প্রচারে পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার অনুদানকারী ব্যাংক ও ফ্লিট মালিকদের কোনো শাস্তিই হচ্ছে না। উল্টে পুরস্কৃত হচ্ছেন তাঁরা। অথচ দূষণযুক্ত ঋণদান নীতির কারণে দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি হওয়া চালকেরা মুক্তি পাচ্ছেন না বরং আরও নিষ্পেষিত হচ্ছেন। সিটির ট্যাক্সি শিল্পের এক বিশেষজ্ঞের মূল্যায়ন অনুযায়ী “মেয়রের ক্যাপিং প্রক্রিয়া প্রস্তাব প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ, আর প্রকৃত সমস্যাটি হচ্ছে ‘ব্যাধিগ্রস্ত’ ঋণ প্রক্রিয়া”।