এরশাদের অকপট স্বীকার এবং...

৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে তৎকালীন জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল সরাসরি নির্বাচন বর্জন করেছিল। অংশ নিয়েছিল সম্মিলিত বিরোধী দল। পাকিস্তান কর্তৃক সৃষ্ট বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টিসহ আরও কয়েকটি ছোট ছোট দল। নির্বাচনে ২৫১টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি আবার সরকার গঠন করে। মাস তিনেক পর জেনারেল এরশাদ সুনামগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলায় সরকারি সফরে সুনামগঞ্জ আসেন। জনসভার আয়োজন হয় শুধু তাহিরপুর মাঠে।
ঢাকা থেকে জেনারেল এরশাদকে নিয়ে উড়া হেলিকপ্টার প্রথমে থামল সুনামগঞ্জ স্টেডিয়াম মাঠে। নেতাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে গেলেন দলের কয়েকজন স্থানীয় হোমড়াচোমড়া নেতা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পরিচিত কিছু মুখ যাদের দেখে অবাক হইনি। সবার মনে যেকোনো উপায়ে সরকারি দলে স্থান করে নেওয়ার তীব্র বাসনা। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন জাতীয় ও আঞ্চলিক সব নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী এক পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য। আরও ছিলেন সিলেটের আঞ্চলিক আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন একসময়ের ডাকসাইটে ছাত্রলীগ নেতা। সবাই দল বেঁধে কবি এরশাদের দোয়া নিতে সুনামগঞ্জ এসে উপস্থিত। বেশ বড় আকারের জটলা।
শাসক দলের জেলা কমিটির সভাপতি মরহুম রফিকুল বারী চৌধুরীর নেতৃত্বে জেনারেল এরশাদকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল সহকারে অস্থায়ী হেলিপ্যাড থেকে হেঁটে হেঁটে আসলেন পুরোনো ডাক বাংলোতে। নেতার পরনে নীল রঙের সাফারি। এই গরমেও গলায় লাল স্কার্ফ। পরে সার্কিট হাউসে এসে খুলে ফেলেছিলেন। বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের ওপর জেলা প্রশাসকের তৈরি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা চলছে ডাকবাংলোর বারান্দায়। একপর্যায়ে স্থানীয় এক সুধীজন প্রস্তাব করলেন, ভারত থেকে নেমে আসা আচমকা ঢলের পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা, তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। এরশাদ প্রস্তাবদাতার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে উঠলেন, কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না, ওরা শুনবে না।
কথাটি শেষ করেই এরশাদ বললেন, শুনুন তাহলে আমার অভিজ্ঞতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন প্রয়াত রাজীব গান্ধী। আমি (এরশাদ) নিজে তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে নিয়ে দিল্লি গেলাম গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করতে। মাহমুদ সাহেব সঙ্গে নিয়ে গেছেন আমেরিকার নাসা থেকে সংগৃহীত গঙ্গার উৎপত্তি ও ভাটির জল প্রবাহের মাপ–জোক। দুই রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সামনে সেই তথ্য উপাত্ত নিয়ে শুরু হলো আলোচনা। শুরুতেই রাজীব গান্ধী অনেকটা ধমকের সুরে বলে উঠলেন, আমরা দুই প্রতিবেশী দেশ বসেছি নিজেদের সমস্যা সমাধানে। সেখানে তৃতীয় দেশের তৈরি তথ্য নিয়ে আলোচনা করব না। বন্ধ করুন আপনার এই উপস্থাপনা। নাসার তথ্য নিয়ে আমাদের (ভারতের) মতামত ভিন্ন।
ঘটনাটি নিয়ে জেনারেল এরশাদ আফসোসের সুরে বলেছিলেন, সেই ধমকের বদলে ফিরতি ধমক দেওয়ার মতো সাহসী লোক এই দেশে একজনই ছিলেন। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি কাউকে এই দেশে আর দেখিনি তখন।
মাত্র দুই ফুট দূরত্বে বসে নিজ কানে জেনারেল এরশাদের মুখে এই গল্প শোনা। ফিরে আসি অন্য প্রসঙ্গে। দুঘণ্টা বিরতির পর এরশাদ চলে গেলেন সার্কিট হাউসের পূর্বের ভিআইপি রুমে। হাত–মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। ছয় ফুটের বেশি লম্বা। লাল টকটকে এরশাদ সাহেব ডানে–বামে দেখছেন। পাশে দাঁড়ানো ডিজিএফআইয়ের সিলেট ইনচার্জ। পাওয়ার ফুল কর্নেল। নামটি স্মরণে নেই। সিভিল পোশাকে। এরশাদ সাহেব তাকাতেই ওনার কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বললেন। ব্যাস এরশাদ সাহেব মুচকি হেসে প্রথমে ডাক দিলেন। চেয়ারম্যান কোথায়? বারান্দায় তখন না হলে ডজন খানিক চেয়ারম্যান। সবার মুখ চাওয়াচাওই দেখে তিনি বললেন, আমার নেক কই। নেক ভাই এগোতেই। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, রুপু তুমিও চলো। ভাবখানা যেন এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিলেন। আসলে তা নয় কিন্তু। কর্নেল সাহেব আগেই সাদা একটি কাগজে আসনের চিত্র এঁকে দেখিয়ে দিয়েছিল, আমরা দুজন হেলিকপ্টারে কোন আসনে বসব। চার–চার আট আসনের কপ্টারে প্রথম লাইনে এরশাদ সাহেব ও ওনার সফর সঙ্গী। পরের আসনে প্রথমে একজন তারকাবিশিষ্ট আর্মি অফিসার, তারপর নেক ভাই। সোজা এরশাদ সাহেবের পেছনে। তারপর আমি। এরপর সেই কর্নেল। পরে তাহিরপুর গিয়ে পরিচয় হয়েছিল। তাহিরপুরে জনসভার অনেক লম্বা কাহিনি। কপ্টার যখন আকাশে উড়ে লক্ষনশ্রীকে বামে রেখে তাহিরপুর অভিমুখে রওনা দিল। সুরমার পাড়ের আমাদের জল জোছনার শহর এক নজরে দেখলাম।
ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের মতো। প্রয়াত জাহানুরদের বাসার সামনে থেকে সোজা বড় পাড়ার শেষে বামে মোড় নিয়ে চলে গেল প্রয়াত জননেতা আবদুল জহুর সেতু ছাড়িয়ে। শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার মতো শেষ বিষয়।
কপ্টারে ওঠার সময় সিলেটের সেই বিপ্লবী নেতা এসে সামনে দাঁড়ানো মাত্রই এরশাদ সাহেব বলে উঠলেন, না তোমার সঙ্গে আমার কথা নেই, তুমি আমার কথা শুনোনি। বলেই কপ্টারে উঠে গেলেন। এখানে বলা প্রয়োজন, সেই নেতা ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে। জেনারেল এরশাদ সে জন্য নারাজ ছিলেন নেতার ওপর। এই নেতা এখনো মাঝে মধ্যে মার্কিন মুল্লুকে বেশ লম্বা সময়ের জন্য অতিথি হয়ে আসেন।