কোন প্রজন্ম গড়ছে বাবা-মায়েরা!

শৈশব হতে মা–বাবার সুন্দর সম্পর্ক, স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল সুস্থ ধারার পারিবারিক কাঠামোর ওপর মানুষের জীবনের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু পরিবারটি যদি তার জন্য একটি অসহযোগিতামূলক স্থানে পরিণত হয়, তবে তার পূর্ণ মানবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। কানাডার টরন্টোতে অতি সম্প্রতি ঘটে গেছে একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড। ঘটনায় অভিযুক্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিনহাজ জামান (২৩)। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজেরই পরিবারের চার সদস্য তাঁর মা, বাবা, বোন ও নানিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
খবরে জানা গেল, মিনহাজ তিন বছর ধরে এই নির্মম হত্যার পরিকল্পনা করছিল। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নির্বিকারভাবে তার কম্পিউটার কিলিং গেমের নেটওয়ার্কের সতীর্থ বন্ধুদের সব জানায়। মিনহাজ জামান টরন্টোর একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষেই কয়েকটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। এর ফলস্বরূপ তিনি মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তি ও কিলিং গেমের দিক ঝুঁকে পড়েন। তিন বছরের দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে একটি শপিং মলে ও শরীরচর্চার জিমনেসিয়ামের সময় কাটাতেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার বাবা–মা কেউই তার এই অবস্থার বিষয়ে অবগত ছিলেন না। তাঁর সমাবর্তনের আগের দিন তিনি এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটান।
কিন্তু কেন মিনহাজ আবেগ–অনুভূতিহীন আর নির্মম হয়ে উঠল? ঘটনাটির পরিণতি কতটা ভয়াবহ, সে কেন অনুভব করল না? কী কারণে সে একান্ত অন্ধকার এক যান্ত্রিক জগতের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল? পরিবারটির সঙ্গে আমি সরাসরি পরিচিত নই। তবে কানাডীয় বাংলাদেশি নিউজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও বিভিন্ন সংবাদ বার্তার প্রাসঙ্গিক তথ্য অনুসারে বিষয়টি নিয়ে অবগত হই। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে কানাডার প্রবাসের সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিষয়টি একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নিচ্ছি মাত্র।
আমি উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে নরওয়েতে এবং পরে অভিবাসী হিসেবে কানাডায় দুটি প্রদেশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করছি। লক্ষ্য করেছি, প্রবাসে অবস্থানরত ভিন্ন পরিমণ্ডলের বাস্তবতায় অনেক অভিবাসী মা–বাবার কম–বেশি স্বপ্ন থাকে তাঁর সন্তানেরা যেন একটি ভালো স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু সন্তানটি প্রকৃতপক্ষে কোন বিষয়ে পড়তে আগ্রহী, তার মেধা সক্ষমতা সম্ভাবনার দিকটি মা–বাবা বিশেষ বিবেচনায় আনেন না। অনেকাংশে জোরপূর্বক ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এমন কোন বিষয়ে যাতে সন্তান অনিচ্ছুক। এ ক্ষেত্রে মা–বাবার একমাত্র লক্ষ্য, সন্তানটি তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করবে কোন শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের ভালো ছাত্র হিসেবে।
মা–বাবার আত্মতৃপ্তির উৎসটি যখন বৃহত্তর সামাজিক কিছু মানুষের বাহবা পায়, তখন তাই হয় প্রকৃত জটিলতার সৃষ্টির কারণ। আধুনিক সমাজ সৃষ্ট প্রতিযোগিতাময় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের কাছে বারবার হেরে যায় সন্তানের কোমল মনের স্বাভাবিক চাহিদা, স্বাভাবিক বিকাশ। মানুষ সামাজিক জীব, তাই সমাজের গ্রহণযোগ্যতার প্রত্যাশা দোষের নয়। তবে তা অবশ্যই আপনার সন্তান বা প্রিয়জনদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক আর ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। সর্বশক্তিমানের কৃপায় মা–বাবার জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন তাঁর সন্তান। তাঁর মধ্যে কোন মানবিক অনুভূতি দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নিল না, তার মধ্যে ভয়, রাগ, সঠিক সম্মান প্রদর্শনের প্রকাশ থাকল না, তার নৈতিক চরিত্রে গঠন হলো না। পরিবর্তে সে শুধু ভালো ছাত্র হওয়ার প্রতিযোগিতায় লড়াই করে চলল—এমন সন্তানকে কি বোধসম্পন্ন মানুষরূপে আখ্যা দেওয়া যায়? সমাজের সাফল্যের নির্ধারক কয়েকটি পেশা—চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যাংকার, গবেষক ইত্যাদি হলেই সে সার্থক মানুষ। আর অন্য কোন পেশার তেমন মূল্যবান নয়—এ ধারণা থেকে বের হতে হবে।
দেশে ও প্রবাসে আরেকটি প্রাসঙ্গিক দিক হলো, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ও সামাজিক বিভিন্ন আপ্যায়নে অনেক মা–বাবা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন। সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন আয়োজন আর অতিথি আপ্যায়নের হাসিখুশি মুহূর্তের ছবিগুলো প্রতি মুহূর্তেই তুলে ধরেন। ইতিবাচক আনন্দময় যা অন্যকে প্রেরণা দেয়, তা শতভাগ করা তেমন দোষের নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও পরিমিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আজকের মা–বাবার প্রতি আমার প্রশ্ন হলো, প্রকৃত অর্থে এই হাসির অন্তরালে আপনার প্রিয়জন আর সন্তানের মনের গহিনের কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে—সে খবর কি রাখছেন? আপনার প্রিয়জন অথবা প্রিয় সন্তানটির জন্য কতটুকু সময় পাশে থাকছেন, সেকি তাঁর চাওয়া–পাওয়ায়, সম্ভাবনার দিকটা মা–বাবাকে অবলীলায় বলতে পারছে?
দুঃখজনক একটি দিক হলো, বর্তমানের অনেক মা–বাবা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন ডিভাইস যেমন আইফোন, আইপ্যাড দিলে আধুনিকতার শিক্ষা শেষ। কিন্তু ডিভাইসগুলো ধ্বংসাত্মক কিছু শিক্ষাদান করছে কিনা, তা নিয়ে তারা বিচলিত নন মোটেই। আমি তথ্য প্রযুক্তি–নির্ভর বর্তমান সভ্যতায় আধুনিক ডিভাইস ব্যবহারের বিপক্ষে নই। তবে সন্তানটি কীভাবে ব্যবহার করছে, সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।
আমার দুটি যমজ সন্তানের মধ্যে একজন অটিস্টিক। অটিজমে আক্রান্তদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আচরণগত থেরাপির প্রয়োজন হয়। প্রবাসে আমার স্বামীর সীমিত ও একক উপার্জনের ওপর ভিত্তি করে বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রাইভেট বিশেষ থেরাপির ব্যয়ভার বহন প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই আমার মায়ের সূত্রে প্রাপ্ত দেশের ভূ–সম্পত্তি, ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিতে হয়ে। কারণ কানাডার হালিফ্যাক্সা সরকারিভাবে পরিচালিত অটিজমের থেরাপি পর্যাপ্ত নয়। সমাজ–পরিবার থেকে ক্রমাগত বাধা সমালোচনা এসেছে। কিন্তু আমি পিছপা হইনি। তার মঙ্গলার্থে সব তুচ্ছরূপে গণ্য করেছি। আমার বাবা–মা দুজনেই পেশায় অধ্যাপক আর শিক্ষক। তারা দুজনেই জীবনভর আমাকে কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়, সেই শিক্ষা দিয়েছেন। আমি সেই একই পথের অনুসারী হওয়ার চেষ্টা করি আমার সন্তানদের জন্য।
সন্তানকে সময় দিতে হবে, তার জীবনের প্রতিটি সমস্যা, তাঁর শারীরিক মানসিক পরিবর্তনে তার নিরাপত্তার দিকে নজর রাখতে হবে। প্রবাসে মা–বাবার ব্যস্ততা সত্ত্বেও সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলার অভ্যাস বজায় রাখতে হবে। সম্মান, সহনশীলতা, অন্যায় ও এর পরিণতি, ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা সম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে। মা–বাবারা এমন এক দূরত্ববিহীন সম্পর্ক গড়ে তুলবেন যাতে সন্তান তাঁর প্রতিটি বিষয় মা–বাবার কাছে বন্ধুরূপে নিশ্চিন্তে সহভাগ করতে পারে। তার সৃষ্টিশীল গঠনমূলক কাজে হাতে–কলমে শেখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের ভাষা, কৃষ্টি–সংস্কৃতি, মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষা দিতে হবে, যাতে সে তার মূল শিকড় থেকে বিস্মৃত না হয়। আমরা আর কোন যন্ত্রনির্ভর বোধহীন মিনহাজকে প্রত্যাশা করি না, নির্মমতার পুনরাবৃতি চাই না।
সর্বশক্তিমানের কাছে নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। সভ্যতার সঠিক প্রতিনিধিরূপে আমাদের একান্ত কামনা, সুস্থ বোধসম্পন্ন মানবিক প্রজন্ম। গীতিকার রামপ্রসাদ সেনের কালজয়ী ভক্তিমুকুল সংগীত ‘মা হওয়া কি মুখের কথা, ‘প্রসব করলেই হয় না মাতা, (যদি) না বুঝে সন্তানের ব্যথা’—এর মূলভাব আজকের মা–বাবা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য এবং সেই অনুসারে একটি শিশুর বিকাশ ও উন্নয়নে ব্রতী হতে হবে।