সন্তান সুস্থ হবে, দেবে নিশ্চয়তা?

যেহেতু পেশায় আমি একজন চিকিৎসক, মানুষের নানা ধরনের অবস্থার মুখোমুখি আমাকে প্রায়ই হতে হয়। আজকে অদ্ভুত একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বেশ অবাকই হলাম। ধরুন কাল্পনিক একটা নাম দিলাম রাজ এবং তার স্ত্রী শ্যারন। নতুন বিয়ে করেছেন। একজন বাংলাদেশি, অন্যজন ইউরোপীয়। আমি তাদের চিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে। তারা একসঙ্গে থেকেছেন অনেক দিন। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন। বেশ ঘটা করে বিয়ে করেও ফেললেন। খুব আনন্দময় মুহূর্ত। এরপর তারা এলেন আমার চেম্বারে। বললেন, ‘ডাক্তার, আমরা বাচ্চা নিতে চাই না’।
তবে শ্যারন বলছেন, ‘স্বাভাবিক’ বাচ্চা যদি হয়, তাহলে তিনি নিতে চান। আর রাজ বলছেন, ‘আমার সন্তান যে অটিস্টিক হবে না, তার কি কোন নিশ্চয়তা রয়েছে?’ শতভাগ নিশ্চয়তা পেলেই কেবল রাজ সন্তান নিতে আগ্রহী। ব্যাপারটি শুনে ভীষণ ভয়ংকর মনে হলো আমার কাছে। মানুষ এখন সন্তান নেওয়ার আগেও নিশ্চয়তা চায়—স্বাভাবিক হবে, নাকি অস্বাভাবিক; মানে প্রতিবন্ধী!
দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন এভাবে ভাবছেন তাঁরা? রাজ বললেন, ‘দেখুন আমার বয়স ৩৫ বছর। আমি হয়তো আরও ৩৫ বছর বাঁচব। এ রকম একটি সিদ্ধান্তে আমি কেন যাব? যদি আমার বাচ্চাটা প্রতিবন্ধী হয়, তাহলে তার পেছনে সময় দিয়ে বাকিটা জীবন কেন আমি নষ্ট করব? তার চেয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী এভাবে একা একা থাকব, সেটাই ভালো।’ তাঁর আরেকটি যুক্তি হলো, ‘ধরুন আমার বাচ্চাটি স্বাভাবিক হলো। কিন্তু আমার নাতিরা যে স্বাভাবিক হবে, তারও তো নিশ্চয়তা নেই।’
এমন অবস্থায় সেই দম্পতি কী সিদ্ধান্ত নিল—সেটা না–হয় নাইবা বললাম। কিন্তু পরিস্থিতি বেশ ভয়ংকর। আমি যখন নিজে আমার দুই সন্তানের দিকে তাকাই, কৃতজ্ঞতায় চোখ ভরে যায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের দুটি সুস্থ বাচ্চা দিয়েছেন। ভবিষ্যতে তাদের বাচ্চাদের সুস্থতা অবশ্যই কামনা করব, তবে তাদের ভবিষ্যৎও অজানাই রয়ে গেছে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, ভবিষ্যতে সন্তান কেমন হবে, সেটা আগেই ভেবে সন্তান নেওয়া যায় না। আমরা সেটা করিনি, আমাদের বাবা মায়েরাও করেননি। আজকাল কোন কোন মানুষ যেভাবে ভাবতে শুরু করেছেন, তাতে আমার মনে প্রশ্ন, তবে কি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলব?
সেই সব বাবা-মায়ের জন্য সত্যিই কষ্ট হয়, যাদের বাসায় এমন সন্তান রয়েছে—প্রতিবন্ধী বাচ্চা। যাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা তারাও জানে না। আসলেই পরিস্থিতি বড়ই ভয়ংকর। আমরা যেহেতু পশ্চিমা বিশ্ব আমেরিকায় থাকি; আমাদের সামাজিক সেবা অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালো। ভবিষ্যতে বাবা-মা না থাকলেও হয়তো নার্সিং হোম সেবা দিয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এখনো তেমন সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। যে কারণে তারা বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে ভবিষ্যতে ভালো থাকবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়! হয়তো তাদের ভাইবোন প্রিয়জনেরা দেখবে। কিন্তু না–দেখার সম্ভাবনাই আমি বেশি দেখি। কেননা এখনকার বদলে যাওয়া সময়ে আসলে আত্মীয়স্বজনদেরও সময় নেই।
তাহলে উপায় কি? উপায় আমার জানা নেই। পরিস্থিতিটা মনে হয় একটা ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। উত্তরণের উপায় কি? সেটাও জানা নেই। পুরো খেলাটিই খেলছেন সৃষ্টিকর্তা। আমাদের কাজ পরিস্থিতি সামলে চলা। সেই সব বাবা–মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, যারা তাদের সন্তানদের এতটা মমতা দিয়ে লালন-পালন করে চলেছেন।