টিক্কা খানকে চেঙ্গিস খানের সঙ্গে তুলনা

২০তম পর্ব

পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জনমতের চাপে আমেরিকার সরকার ঘোষণা করে, তারা পাকিস্তানে কোনো রকম সামরিক সাহায্য দিচ্ছে না। অথচ নিউইয়র্ক টাইমস জানতে পারে, আমেরিকা পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দিচ্ছে। এই নিয়ে তারা ‘দমননীতিতে উৎসাহ’ [Abetting Repression] শিরোনামে ২৩ জুন একটি সম্পাদকীয় লেখে।

সংক্ষেপে সম্পাদকীয়তে যা বলা হয়েছে—
আমেরিকার জনপ্রতিনিধিরা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের দমননীতির প্রতিবাদে সেখানে কোনোরকম সামরিক সরঞ্জাম না পাঠাতে সরকারের প্রতি জোরালো দাবি উপস্থাপন করেন। জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা পররাষ্ট্র দপ্তর সিনেটের ফরেন রিলেশন কমিটির কাছে ২৩ এপ্রিল একটি চিঠি লেখে যাতে বলা হয়, ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স আমাদের জানিয়েছে, ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকারকে অথবা তার কোনো প্রতিনিধিকে কোনো সামরিক সরঞ্জাম প্রদান করা হয়নি এবং কোনো চালান তালিকাভুক্ত নি।’
গত মাসে ভারতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও এই তথ্য জানান হয়। কিন্তু গতকাল নিউইয়র্ক থেকে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে একটি চালান পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছেড়ে গেছে বলে জানা যায়। আরও জানা গেছে, এ রকম আরেকটি জাহাজ ইতিপূর্বেও সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে পাকিস্তান গেছে। আর সেটি ঘটেছে যেদিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সিনেট কমিটিকে চিঠি দিয়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাঠান হবে না বলে জানিয়েছিল।
এই চালান আমেরিকার জনগণ, কংগ্রেস ও বন্ধুভাবাপন্ন একটি দেশের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করা। এর ফলে আমেরিকা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিও দুর্বল হয়েছে। এটা আমেরিকার সরকারকে দমননীতির পক্ষে নিয়ে গেছে, আদর্শগতভাবে যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থানের নীতির বিপরীত।
২৫ জুন হংকং স্ট্যান্ডার্ড বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপে যার শিরোনাম ছিল, ‘আরেকজন চেঙ্গিস’ [Another Gengish]
শত শত বছর যাবৎ নিষ্ঠুরতা ও হত্যালীলার জন্য চেঙ্গিস খানের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু এখন এই ২০ শতকে ভয়ানক হত্যাকারী হিসেবে তার নামের সঙ্গে আরেকজনের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি হলেন পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান, যিনি আধুনিক যুগে সূক্ষ্মভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহ দমনের নামে পাঞ্জাবি এবং পাঠানদের মাধ্যমে বাঙালিদের রক্তে স্নান করছেন।
শিশুসহ অসংখ্য মানুষ হত্যা, মেয়েদের ধর্ষণের অকাট্য প্রমাণ মিলছে। চেঙ্গিস খান তবুও নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য মানুষ হত্যা করেছিল। কিন্তু টিক্কা খান নিজ দেশের মানুষের অধিকারের টুটি চেপে ধরতেই এ কাজে লিপ্ত।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা সিডনি এইচ সেনবার্গ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের মানবেতর জীবন নিয়ে কলকাতা থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন যা জুন ২০ সংখ্যায় ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল, ‘নরক’ শুধু এই নামেই এটাকে বর্ণনা করা যায় [Refugees; The only way to describe it is ‘Hell’]
ভারতের প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে ভারতীয় পার্লামেন্টে বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখার জন্য আমাদের নরকের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।’ তিনি পার্লামেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনে ৬০ লাখ বাঙালির শরণার্থী হিসেবে আগমনের এক বিতর্কে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা করছিলেন।
এখন পর্যন্ত শিবিরগুলোতে প্রায় ৫০০০ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও মানুষ এখনো প্রাণ হারাচ্ছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে—অপুষ্টি, টাইফয়েড, আমাশয়, নিউমোনিয়া। এর ওপর বর্ষার বৃষ্টি এদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে, বিশেষ করে ২০ লাখ শরণার্থী যারা ক্যাম্পে জায়গার অভাবে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। ভারতের সীমিত সম্পদের মাধ্যমে এই বিপুল শরণার্থীদের পূর্ণ সহায়তা দেওয়া অসম্ভব, তার ওপর প্রতিদিনই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা শরণার্থী ও আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বর্তমানে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং সস্তায় অনেক শ্রমিক পাওয়ায় সীমান্ত এলাকার শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস পেয়েছে যাতে করে মানুষের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ভারত সরকার শরণার্থীদের সীমান্ত এলাকা থেকে কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরিয়ে নিতে চাচ্ছে। তবে শরণার্থীরা সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি অর্থাৎ তাদের ছেড়ে আসা বাড়িঘরের কাছে অবস্থান করতে চাচ্ছে।
শরণার্থীদের জন্য যদি প্রতিদিন এক রুপি (অর্থাৎ তখনকার হিসেবে ১৩ সেন্ট) খরচ ধরা হয়, তবে এক বছরের জন্য খরচ লাগে ৩০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ কোটি ডলার। ৫৫ কোটি মানুষের একটি দেশে যাদের বছরে গড় আয় ৮০ ডলার তাদের পক্ষে এই বিশাল খরচ বহন করা অসম্ভব।
ভারত হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তার বুনন ঠিক রাখতে যুদ্ধে যাবে, যদিও কোনো পক্ষেই এখনো যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না এবং এই এলাকার কূটনীতিকেরা মনে করেন, যুদ্ধ এখনো অবশ্যম্ভাবী নয়। রাজনীতিকেরা সরকারকে কঠোর নীতি অবলম্বনের জন্য অনুরোধ করছে। সংবাদপত্রগুলো বলছে শরণার্থীদের জন্য এখন পর্যন্ত যত খরচ হচ্ছে, যুদ্ধ তার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী হবে। তারা উল্লেখ করছে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে খরচ হয়েছিল মাত্র ৭ কোটি ডলার। শরণার্থীদের জন্য খরচ এর চেয়েও অনেকগুণ বেশি, যা প্রতিদিনে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ ডলার। তবে ভারতে উচ্চপদস্থ সামরিক সূত্র বলছে, যুদ্ধ হলো শেষ অবলম্বন।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা ম্যালকম ব্রাউন ২০ জুন করাচি থেকে খবর পাঠান যে, পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিকদের জন্য আবার অবারিত করা হয়েছে। তারা নিজ দায়িত্বে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারেন।
হাস্যকরভাবে ৩০ জুন নিউইয়র্ক টাইমস–এর সংবাদদাতা সিডনি সেনবার্গকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে চাইলে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাকে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই বহিষ্কার করা হয়, নয়াদিল্লি থেকে রয়টার পাঠানো সংবাদটি নিউইয়র্ক টাইমস–এ ছাপা হয় ১ জুলাই। গত মার্চ মাসে যে ৩৫ জন সাংবাদিককে বহিষ্কার করা হয় সেনবার্গ ছিলেন তাদের একজন। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]