ঈদে মনে পড়ে দেশের কথা

এখানে ঈদে দেশীয় পোশাক পরেন অনেকে। মডেল হয়েছেন ইসরাত জাহান সিফাত
এখানে ঈদে দেশীয় পোশাক পরেন অনেকে। মডেল হয়েছেন ইসরাত জাহান সিফাত

হই হই রই রই, চারদিকে হই চই—ঈদ মানেই এমন এক অনুভূতি। প্রবাসে এটি স্বপ্ন। ঈদুল আজহা বা কোরবানি ঈদ আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ একটি ধর্মীয় দিন। বাংলাদেশের মতো বাড়িতে বাড়িতে কোরবানি দেওয়ার নিয়ম নেই এই বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনে। কিন্তু ফার্মে গিয়ে অনেকেই ঈদের দিন কোরবানি দেন। আবার কেউ কেউ বাঙালি বা মুসলিম গ্রোসারিতে কোরবানির জন্য তাদের নাম দিয়ে থাকেন, গ্রোসারিতে দিলে কখনো ঈদের দিন বা পরের দিন সেই মাংস নিয়ে আসতে হয়।

দেশের বাইরে আসার পর প্রথম কয়েক বছর কোরবানির জন্য দেশেই টাকা পাঠানো নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ফলে কোরবানির মাংস ছাড়াই ঈদের খাওয়া-দাওয়া করতে হতো। কোরবানির ঈদ মাংস ছাড়া—এটি ভাবতেই কষ্ট হতো বেশ। কেমন জানি তখন এলোমেলো হয়ে যেতাম। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে ঈদ করছি, এটাই কত কষ্টের ছিল। তার ওপর মাংস নাই কোরবানির! মেনে নিতে অনেক সময় নিয়েছিল।

এখানে ঈদে দেশীয় পোশাক পরেন অনেকে। মডেল হয়েছেন ইসরাত জাহান সিফাত
এখানে ঈদে দেশীয় পোশাক পরেন অনেকে। মডেল হয়েছেন ইসরাত জাহান সিফাত

মনে পড়ত শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা। শৈশবের জীবনটা ছিল বড় আনন্দের। জীবন ছিল প্রজাপতির মতো। জীবনের চাঞ্চল্য ছিল, ভাবনাহীন জীবন ছিল, ছিল অনেক আশা খুনসুটি আর ভালোবাসা। বড়রা যখন ঈদের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হতেন, আমরা ছোটরা তখন বাড়ির ছাদে উঠে চাঁদ দেখা নিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি ছুড়ে দিতাম আকাশের বিশালতায়। ছোট ছোট চোখ দিয়ে বিশাল আকাশের দিকে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখতাম, তারই ফাঁকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে ঈদের চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। সেই চাঁদ দেখতেও কত আনন্দ। কোরবানি ঈদগুলো থাকত আরও বেশি আনন্দের। এই ঈদের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত গরু, ছাগল, ভেড়া কেনার প্রতিযোগিতা। বাবা, ভাই কেয়ারটেকারকে নিয়ে চলে যেত হাটে। অনেক খুঁজে সারাগায়ে ধুলোবালি, দুপায়ে কাঁদা কখনো গোবর লাগিয়ে হাসিমুখে গরু নিয়ে আসত, যেন কোনো রাজ্য জয় করে আসছে।

বাংলাদেশে কোরবানি ঈদের আয়োজন কয়েকদিন আগেই শুরু হয়ে যেত। বেশির ভাগ মানুষের বাসার সামনে গরু কিংবা ছাগল দেখা যেত। চোখের সামনে কেউ গরু নিয়ে যেতে দেখলেই গলা উঁচিয়ে দাম জিজ্ঞেস করা ছিল ঈদের আনন্দের একটা বিশেষ পার্ট। আর ঈদের দিনের আনন্দ খুব সকাল থেকেই শুরু হতো। গরু-খাসি জবাই, তারপর মাংসের ভাগ থেকে শুরু করে তা আত্মীয়, প্রতিবেশী, গরিবদের মাংস বিলি করার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। ঈদ আসলে সবার কাছেই খুব আনন্দের। আমরা যারা প্রবাসে থাকি, তাদের দেহ থাকে প্রবাসে আর মনটা দেশে। ছোটকাল থেকেই ঈদ মানে ছিল নতুন জামা-কাপড়। যতটুকু সম্ভব ঘুরে বেড়ানো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বিশেষ পরিচিতদের কাছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দগুলোও ছোট হয়ে আসে।

এখানে ঈদে দেশীয় পোশাক পরেন অনেকে। মডেল হয়েছেন ইসরাত জাহান সিফাত
এখানে ঈদে দেশীয় পোশাক পরেন অনেকে। মডেল হয়েছেন ইসরাত জাহান সিফাত

বিদেশ মানেই যান্ত্রিকতায় ভরা জীবন। তারপরও এত যান্ত্রিকতার মধ্যেও ঈদ প্রবাসীদের জীবনে কিছু আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। প্রবাসে ঈদের আমেজ খুঁজে পাওয়া যায়, ঈদগাহে গিয়ে। প্রবাস জীবনের ঈদ মানে সারা রাত জেগে বিভিন্ন সুস্বাদু রান্না করা। খুব অল্পসংখ্যক মসজিদ আছে এখানে। এখানে ঈদের সকালে নামাজ পড়ার জন্য অনেক মুসলিম কমিউনিটি বিচের পাড়ে ব্যবস্থা করে। বড়দের নামাজের পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য অনেক ধরনের উপহার রাখে। আমরা যারা কিছু পরিবারকে চিনি, সে জন্য আমাদের ঈদের দিন আসা-যাওয়াও এই কয়েক পরিবারের সঙ্গে। দিনটি প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানো খুবই আনন্দের। কিন্তু প্রবাসীরা এ আনন্দ থেকে প্রায় সময়ই বঞ্চিত হয়। প্রবাসে ঈদের দিনও অনেকেই যেতে হয় কাজ করতে, ঈদের জন্য নেই তাদের ছুটি।

বাংলাদেশের এই ঈদের আমেজ অনেকটাই অনুপস্থিত আমাদের প্রবাসী জীবনে। তাই তো ঈদের দিনে না চাইলেও মনে পড়ে যায় সেই পুরোনো দিনের কথা, কাছের অতি প্রিয় মানুষগুলোর কথা। ফেলা আসা হারানো দিনের ঈদের আনন্দ এখন কেবলই স্মৃতি। সবাই ব্যস্ত যার যার মতো। প্রবাসে আমরা সংখ্যালঘু, তাই ঈদের আনন্দ অনুভূতিগুলো মনের ভেতরে আটকে থাকে। আমাদের যাদের পরিবার আছে, তারা কয়েক পরিবারের সঙ্গে মিলে মিশে ঈদ করলেও অনেকে একা থাকেন পরিবার-পরিজন ছেড়ে। তাদের কাছে নাকি ঈদ মানেই কষ্ট। আপনজনকে কাছে না পাওয়ার দুঃখ তাদের ঈদের আনন্দকে বেদনায় পরিণত করে। যদি তাদের কোনো পরিবারের সঙ্গে পরিচয় থাকে সেই সুবাদে ঘরের খাবারের স্বাদ তারা পায়, তা না হলে হোটেলের খাবার খেয়ে ঈদ শেষ করে। স্বজনহীন ঈদ সবাইকে কষ্ট দেয়।