জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো জাতীয় শোক দিবস পালন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্ম: ১৭ মার্চ ১৯২০। মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ছবি: আলহাজ জহিরুল হক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্ম: ১৭ মার্চ ১৯২০। মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ছবি: আলহাজ জহিরুল হক

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালিত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪ তম শাহাদত বার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টায় জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের উদ্যোগে সংস্থার সদর দপ্তরে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

চার নম্বর কনফারেন্স কক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিনিধি, কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা, নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার মানবাধিকারকর্মী, লেখক, চলচ্চিত্রশিল্পী, টিভি উপস্থাপক, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকারের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি, গণতন্ত্র, শান্তি ও সহাবস্থানের যে আদর্শ জাতির পিতা রেখে গেছেন, তা তুলে ধরেন।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত বাণীর অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। আসুন, আমরা জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করি।’

এ সময় দেশি-বিদেশি দুই শতাধিক অতিথি জাতির জনকের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও বহুপাক্ষিকতাবাদ’ বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্ব বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেন।

জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তুলে ধরা, বহুপাক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নেওয়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে সব অবদান রাখেন, তা উল্লেখ করেন আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ ধারণ করেই বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতাবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বসভায় ভূমিকা রেখে চলছে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ভারত, সার্বিয়া ও কিউবার স্থায়ী প্রতিনিধি এবং প্যালেস্টাইনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক।

ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারতবাসী তাদের অকৃত্রিম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা জানতে পারে, তখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়।’

বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শই আজ জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সৈয়দ আকবরউদ্দিন। ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’

সার্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিলান মিলানোভিচ্ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিকা দাচিচর বাণী পড়ে শোনান। বাণীতে সার্বিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ ব্রোজো টিটোর যে বন্ধুত্ব ও গভীর সম্পর্ক, তা তুলে ধরেন। এবং বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি ‘বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, আর আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও এটা যে, আমি তাদের অনেক বেশি ভালোবাসি’ উল্লেখ করেন।

কিউবার রাষ্ট্রদূত আনা সিলভিয়া রদ্রিগেজ আবাসকাল তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার দেওয়া অকুণ্ঠ কূটনৈতিক সমর্থনের কথা তুলে ধরেন। নির্যাতিতের পক্ষে ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনন্যসাধারণ নেতৃত্ব, প্রচেষ্টা ও সাহসের কথা বলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৩ সালে কিউবার মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বিখ্যাত উদ্ধৃতি ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাই হিমালয় দেখার সাধ আর আমার নেই’ উল্লেখ করেন তিনি।

ফিলিস্তিনির স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ এইচ মনসুর ফিলিস্তিনির প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আজ ৪৪ বছর পর এই জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে, যা এই বিশ্বনেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অনন্য উদ্যোগ।’

অনুষ্ঠানে জাতির পিতার জীবন ও কর্ম এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা ও গান পরিবেশন করা হয়। সবশেষে জাতির পিতা, বঙ্গমাতা এবং ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে স্বাধীনতা-বিরোধী অপশক্তির হাতে নৃশংসভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।