বর্ণবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠ

টনি মরিসন
টনি মরিসন

‘আমরা মারা যাব। খুব সম্ভবত এটিই জীবনের মানে। কিন্তু আমরা জীবনের উন্নতি ঘটাই। সম্ভবত এটাই আমাদের জীবনের মাপকাঠি’—টনি মরিসন। (জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১—মৃত্যু ৫ আগস্ট ২০১৯)
যখন গোটা আমেরিকা ও ইউরোপে বর্ণবাদের বিষবাষ্প, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের চরম ঘৃণা, কৃষ্ণাঙ্গরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে জর্জরিত, কুসংস্কার ও বিভিন্ন অপরাধে নিমজ্জিত, তখন কলম হাতে তুলে নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ পরিবর্তনের সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন টনি মরিসন। দাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও শ্বেতবর্ণের মানুষেরা তখনো কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের তাদের মতোই একজন মানুষ হিসেবে দেখত না। তখনো কৃষ্ণাঙ্গদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো। শুধু গায়ের রং ও শারীরিক আকৃতির পার্থক্যের জন্য শ্বেতবর্ণের দৃষ্টিতে তারা ছিল নিকৃষ্ট বা নিচু প্রজাতির মানুষ। তাদের প্রতি ছিল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আকাশ-পাতাল বৈষম্য। সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই ছিল টনি মরিসনের পথচলা। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে শিশু ও নারী নির্যাতন, বর্ণবাদ বিরোধিতা, কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের প্রতি শ্বেতবর্ণের মানুষদের অমানবিক অবিচার, নির্যাতন ও বৈষম্য।
স্রোতের বিপরীতে সবাই হাঁটতে পারে না। অধিকাংশ মানুষ স্রোতের অনুকূলে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হাতে গোনা বিরলপ্রজ কিছু মানুষ স্রোতের বিপরীতে হেঁটে ইতিহাস রচনা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন কৃষ্ণবর্ণের বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের মানুষের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সাহিত্যকর্মে তিনি তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এটি-ই ছিল আফ্রিকান–আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে প্রথম নোবেলপ্রাপ্তি। টনি মরিসন ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদিকা ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস। তাঁর উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হলো মহাকাব্যিক রীতি, তীক্ষ্ণ কথোপকথন ও পুঙ্খানুপুঙ্খ চরিত্রায়ণ।
১৯৩১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার ওহাইও অঙ্গরাজ্যে এক অ্যাফ্রো-মার্কিন পরিবারে টনি মরিসন জন্ম নেন। তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল ক্লো আর্ডেলিয়া ওফর্ড। তাঁর বাবা জর্জ ওফর্ড ছিলেন জাহাজ কারখানায় ঢালাই শ্রমিক ও মা রামাহ উইলিস ওফর্ড ছিলেন একজন গৃহিণী। ১২ বছর বয়সে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করার সময় নিজের নাম পাল্টে ‘অ্যান্টনি’ করে নেন ক্লো। সেই অ্যান্টনি থেকেই টনির জন্ম। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ১৯৫৮ সালে জ্যামাইকান স্থপতি হ্যারল্ড মরিসনকে বিয়ে করেছিলেন। বছর কয়েক পরে ১৯৬৪ সালে দুজনের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলেও টনির নামে থেকে যায় তার প্রাক্তন স্বামীর ‘মরিসন’ পদবিটি। তাদের দাম্পত্য জীবনে পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখে তাদের দুই সন্তান হ্যারল্ড ফোর্ড ও স্ল্যাড কেভিন।
কর্মজীবনে টনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। একই সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা র‍্যানডম হাউসের সম্পাদক ছিলেন। স্কুলে থাকতে এক শ্বেতাঙ্গ সহপাঠী তাঁর চোখ দেখে বলেছিল, ‘তোমার চোখ আমাদের মতো নীল নয়। তুমি নিশ্চয়ই চাও, তোমার চোখও এ রকম সুন্দর, নীল হোক?’ এই কথাটি মরিসনের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বিশ বছর পরও সেই নীল চোখের স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াত কালো চোখের কালো মেয়েটিকে। নীল চোখ, সোনালি চুল, সাদা চামড়ার বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, নির্মম কিন্তু অপরূপ, শেকলে বাঁধা কিন্তু ডানায় ভর দিয়ে উড়তে উন্মুখ—সেটাই বারবার লিখেছি আমি।’ ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় টনির প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’। এই উপন্যাসে ‘পিকোলা’ নামক কৃষ্ণবর্ণের এক বালিকার নির্দয় ভাগ্য আর অভিশপ্ত জীবনের গল্প লিখেছেন। ছোট্ট পিকোলা নিজেকে চেনার আগে চিনেছে নিজের প্রতি ঘৃণাকে, চিনেছে বৈষম্য আর বিভেদকে, জেনেছে কেবল জন্ম আর বর্ণের ফেরে সে মানব সমাজে নেমে গেছে অনেক নিচে, হয়ে উঠেছে অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র। এই পৃথিবীতে কালো রং, মোটা ঠোঁট ও বোচা নাকের কুৎসিত মানুষের কোনো মূল্য নেই। তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন, এমনকি তাদের হত্যা করা হলেও সেটা গুরুতর অপরাধ নয়।
পিকোলা বুঝতে পারে, নীল রঙের চোখ ও সোনালি চুলের পুতুলের মতো হতে পারলেই মানুষ তাকে আদর করবে। তাই সে ঈশ্বরের কাছে এক জোড়া নীল রঙের চোখ প্রার্থনা করত। নিজ মাতাল পিতা কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার পর সে অনুভব করে, এই প্রথম কেউ তাকে কাছে টেনে আদর করেছে। অকালে গর্ভবতী হওয়ার পর সমাজ তাকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে এবং সে পুরোপুরি বিবর্জিত হয়। তখন পিকোলো ভাবতে থাকে, তার কালো রঙের চোখ সম্ভবত ঈশ্বর নীল রঙে পরিণত করেছে। তাই সবাই ভিন্ন দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে পিকোলোকে তাকিয়ে দেখছে। মূলত টনি মরিসন একজন কৃষ্ণবর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ উপন্যাসের মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারুরূপে বর্ণবাদ, শিশু নির্যাতন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অমানবিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো উপস্থাপন করেছিলেন, যা এক সময় সারা পৃথিবীর বুকে আলোড়ন তুলেছিল এবং পাঠক হৃদয় হয়েছিল দগ্ধ।
এর তিন বছর পর ১৯৭৩ সালে বের হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সুলা’। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে। এই উপন্যাস টনির স্বপ্নকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। লেখক খ্যাতির জন্য তাঁকে অপেক্ষাও করতে হয়নি। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর আরও নয়টি উপন্যাস। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘সং অব সলোমান’। এই উপন্যাসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের ওপর আলোকপাত করা হয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘টারবেরি’। ১৯৮৭ সালে প্রকাশ করেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘বিলাভিড’। একজন আফ্রিকান–আমেরিকান দাস নারীর সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেন এই উপন্যাস। মার্গারেট গার্নার নামের এক ক্রীতদাস নারীর দাসত্ব থেকে পালিয়ে আসার ইতিহাস থেকে টনির এই উপন্যাস লেখা হয়। পালিয়ে আসার পরও গার্নারকে দাস-প্রভুরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। সন্তানকে যাতে দাসত্বে ফিরে না যেতে হয়, সে জন্য সে তার দুই বছর বয়সী মেয়েকে মেরে ফেলে। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে সফল হওয়ার আগেই গার্নার আবার ধরা পড়ে যায়। এখানে প্রমাণিত হয়ে যায়, ক্রীতদাসের জীবনের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। ১৯৯৮ সালে উপন্যাসটি নিয়ে একই নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত টেলিভিশন উপস্থাপিকা অপরাহ্ উইনফ্রে।
এরপর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় টনি মরিসনের নাটক ‘ড্রিমিং ওস্মোট’ এবং ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে তাঁর রচনায় ‘জাজ’ ও ‘প্যারাডাইজ’ নামক আরও দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘গড হেল্প দ্য চাইল্ড’ প্রকাশিত হয়। হালকা শ্যাম বর্ণের ত্বকের অধিকারী মা সুইটনেস তার মেয়ের জন্মের সময় মেয়ের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়। তার মতে, তার মেয়ের কালো চেহারা মধ্যরাতের মতো, সুদানের লোকদের মতো কালো। মা হয়েও মেয়েকে নিজের হাতে ছুঁতে তার ঘৃণা বোধ হয়। মায়ের ঘৃণা ও অবহেলা ছোট্ট মেয়ে লুলা অ্যানের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। সে তার মায়ের স্পর্শ পেতে চাইতো কিন্তু মা তার মুখ দেখতেও চাইতো না। তাই সে ইচ্ছা করে ছোটখাটো ভুলত্রুটি করে, যাতে মা তাকে নিজের হাতে মারে। মার খেয়ে হলেও সে তার মায়ের হাতের ছোঁয়া পেতে চায়। ব্যথার বদলে মায়ের হাতের স্পর্শে সে পুলকিত হতো এবং ভীষণ আনন্দ পেত।
বড় হয়ে লুলা অ্যান হয়ে যায় ব্রাইড। তার জীবনে আসে ভালোবাসে এবং তারা বিয়ে করে। তার প্রেমিক স্বামী ও ব্রাইড তাদের সন্তানের নিরাপত্তা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে অনেক সুন্দর কিছু পরিকল্পনা করে। ব্রাইডের কাহিনির সমান্তরালে তার গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে যায় আরও কিছু ঘটনা। যেগুলোতে দেখা যায় শিশুদের ওপর বড়দের নির্মম নির্যাতন। এক মা তার শিশুকে দিয়ে যৌনতার বেসাতি করে। আরেকজন ভদ্র চেহারার লোক শিশু-কিশোরদের ওপর অত্যাচার করে এবং তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
টনি মরিসন তাঁর সাহিত্যকর্মে কৃষ্ণবর্ণের অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের বাস্তব জীবনের চিত্র সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখালেখির মাধ্যমে বর্ণ বৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য, জাত বৈষম্য বিশ্ব থেকে দূর করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। টনিকে ‘নিখুঁত লেখক’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যিনি ‘অক্ষরসম্পন্ন বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছেন।’ তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত বিলাভিড উপন্যাসের জন্য পরের বছরই তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। একই উপন্যাসের জন্য পান আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড। তিনি ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। মার্কিন সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে পান ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের মেডেল অব ডিস্টিংগুইশড কন্ট্রিবিউশন সম্মাননা। ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে আমেরিকার সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমে ভূষিত করেন।
এই মহীয়সী নারী আমেরিকার নিউইয়র্কে মন্টিফিওরে মেডিকেল সেন্টারে গত ৫ আগস্ট রাতে ৮৮ বছর বয়সে পৃথিবীর বুক থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। বর্ণবাদবিরোধী সদ্যপ্রয়াত টনি মরিসনের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই করে গেছেন, তা গোটা পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।